Wednesday, May 17, 2017

সাপ্তাহিকী ২৭ # তুমি রবে নীরবে


- আমি বিয়ে করব না.......।

কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করতে বেশ কিছুটা সময় লাগে অর্কর, মাথাটা ঈষৎ টলে যায় যেন। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন, তারপর ভুরু কুঁচকে ঝুঁকে আসে সামনে।

- তার মানে ?
- মানেটা যা বললাম, সেটাই.......
- তুমি কি আমার সাথে ইয়ার্কি মারছো ?
- নাহ ! সত্যি বলছি.....

'এসবের অর্থ কি পাখি ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না' !!!  
অর্কর মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। চোখে একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে পাখির দিকে।

- তুমি বুঝবেও না........
- অদ্ভুত তো ! আমার সাথেই বিয়ে, আর আমিই বুঝব না ?

পাখি সে কথার কোনো উত্তর দেয় না। নির্লিপ্ত ভাবে কফিশপের জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে শুধু। তারাতলা-মাঝেরহাট ক্রসিং, অগণিত গাড়ি দুদিক দিয়ে অবিরাম ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে। বুকের মধ্যে ঐরাবতের উন্মত্ততা টের পায় অর্ক।
 
- এক সেকেন্ড ! তোমায় কি কেউ কিছু বলেছে ?
- না....
- স্কুলে কিছু গোলমাল ?
- না....
- তবে ?

পাখি আবার চুপ করে যায়। মুখ নামিয়ে হলুদ ওড়নার খুঁটটা ধরে পেঁচাতে থাকে এক মনে। 

অর্কর সাথে দু বছর হলো বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম। পাশাপাশি দুটো স্কুলে দুজনে শিক্ষকতা করে। একজনের বিজ্ঞান আর আরেকজনের ইতিহাস। অসম বিষয়ের মধ্যে রসায়ন জমতে সময় লাগেনি খুব একটা। টুকরো আলাপচারিতায় সমভাবাবেগ বয়ে গিয়েছিল দুজনেরই হৃদয় জুড়ে। ধীরে ধীরে সে আবেগের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে বিয়ের পিঁড়ির দিকে আরও ঘন হয়েছে। কোনো বাড়িতেই আপত্তি করেনি। বরং হাসি মুখে মেনে নিয়েছে সবাই । বিয়ের দিন আর বেশি বাকি নেই। 

এহেন মোক্ষম সময় অর্ককে প্রায় মাঝসমুদ্রে ফেলে বেঁকে বসেছে পাখি। অর্ক অধৈর্য হয়ে ওঠে ভীষণ। মুখচোখ কঠিন হয়ে যায় তার।

- ওহ !! তুমি বুঝি অন্য কারোর প্রেমে পড়েছ ?
- এতো ঘন ঘন আমি প্রেমে পড়তে পারিনা তোমার মতো.....
- ঘন ঘন ? কি মুশকিল..... অনিন্দিতা তো এখন অতীত। সেটা তুমিও ভালো করে জানো। আর তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর শুধু তোমাকে নিয়েই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি। সুতরাং...........কেন, অনিন্দিতা কি তোমাকে কিছু.......?

বেয়ারা এসে দুটো ব্ল্যাক কফি দিয়ে যায়।

'নাহ....অনিন্দিতা কিছু বলেনি....... কেন ? তেমন বলার মতো কিছু ছিল বুঝি' ? ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিতে দিতে পাখির চোখে ব্যাঙ্গের ইঙ্গিত খেলে যায়।

- দ্যাখো পাখি, এবার কিন্তু ভীষণ বাড়াবাড়ি করছ, কি হয়েছে সেটা বলো, নচেৎ এক্ষুনি তোমার বাড়ি গিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করব এই ব্যাপারে।

- আমার এখন বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না, সেইটে জানাবো বলেই তোমায় ডেকেছি। 
- বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না মানে ??!! বিয়ের আবার এখন তখন কি !!!
- করতে ইচ্ছে করছে না, ব্যাস !

- আচ্ছা, তোমার কি মাথা খারাপ হলো? বিয়ের আর হপ্তাখানেক বাকি, কার্ড বিলি হয়ে গেছে। ডেকোরেটর, ক্যাটেরার সব বলা হয়ে গেছে, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবাই জেনে গেছে, আর তুমি বলছ এখন বিয়ে করব না ??? !!

- ঠিক তাই....
- দ্যাখো, আমার কিন্তু ভীষণ টেনশন হচ্ছে ? সত্যি করে বলো প্লিজ, কি সমস্যা হয়েছে ?
- কিচ্ছু না....
- তোমার বাড়িতে কোনো .....?
- না, কিছু হয়নি.....
- আমার বাবা মা কি কিছু......
- নাহ ! কেউ কিচ্ছুটি বলেনি......
- তাহলে কারণটা কি ? সেটা তো বলবে ? যাই জিজ্ঞেস করছি সবেতেই না বলছ !

- এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।
- আশ্চর্য ! যেখানে তোমার আমার দুজনের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে, সেখানে দুম করে তুমি একা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে !! কেন ?

- তার কারণ তুমি আমায় প্রপোজ করোনি..... !!

আশেপাশের লোকজন মাঝেমাঝেই আড়চোখে তাকাতে থাকে তাদের দিকে । 

অর্ক যেন খেই পায় না কোনো কিছুর। পাখি নানারকম বিদঘুটে আবদার করে এসেছে বটে এ যাবৎ, কিন্তু এটা যেন পুরনো সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে গেল। নিজেকে নিপীড়িত অসহায় মনে হতে থাকে অর্কর। পরিষ্কার করে মনে করতে পারে না যে এমন বিপাকে আগে কখনো পড়েছে কিনা। অপলক, ভাষাহীন দৃষ্টিতে অর্ক তাকিয়ে থাকে পাখির দিকে। পাখির সারা মুখে কোথাও লেশমাত্র কৌতুকের চিহ্ন নেই, বরং এক অদ্ভুত দৃঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছে যেন। সে দৃঢ়তার আলোকছটায় ধাঁধিয়ে যায় অর্ক।

- আজ, এইখানে, এই মুহূর্তে, প্রপোজ করো। তবেই বিয়ে.......নয়ত........ভালো করেই চেনো আমাকে......

অর্ক কাঁদোকাঁদো হয়ে যায় প্রায়। হাত বাড়িয়ে পাখির হাত দুটো চেপে ধরার চেষ্টা করে।

- প্রপোজ করাটাই সবচেয়ে জরুরী হল তোমার কাছে, আর এতদিন যে এত মুহূর্ত একসাথে কাটালাম আমরা, একসাথে পথচলার অঙ্গীকার করলাম, তার কোনো মূল্য নেই বুঝি ? ভালোবাসি কথাটা ব্যবহার করতেই হবে ? একটা শব্দ তোমার কাছে এতো প্রয়োজনীয় ? এতো দামী ?

প্রত্যয়ী পাখির মুখাভাবে কোনোরকম পরিবর্তন হয় না। অর্ক কি করে জানবে পাখির শব্দহীন জগতে ওই একটা মাত্র শব্দ কত গুরুত্বপূর্ণ, কত দুর্মূল্য। ছোটবেলায় এক নির্মম পথ দুর্ঘটনায় মা বাবা হারানোর সাথে সাথে পাখি হারিয়ে ফেলে তার বাক্শক্তি ও শ্রবণ ক্ষমতাও। 

তারপর থেকে কাকাদের কাছেই সে মানুষ। নীরব সংগ্রামের সেই শুরু । ব্যক্তিগত যোগ্যতায় পড়াশোনা শেষ করে একটি মূক ও বধির স্কুলে সে চাকরি পায়। উপযুক্ত ভালোবাসার অভাব বোধ করেছে সে চিরটাকাল। 

অর্কর সাথে দেখা হয়ে তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে সে অনুরাগের সঞ্জীবনী। অর্ক উন্মাদের মতো ভালোবাসে তাকে, সে জানে। পাখির সাথে কথা বলার জন্য অর্ক শিখে নিয়েছিল মুখ ও বধিরের বিশেষ ভাষা। পরিণত যুবক যুবতীর মধ্যে শব্দ কবলিত ভাষা অন্তরায় হয় নি কখনো। ভালোবাসি বলতে হয়নি কাউকেই, বরং সময়ের স্বাভাবিক গতিতে তরতর করে এগিয়ে গিয়েছিল পরিণয়ের পথে। 

তবু আজ পাখি চায় অর্ক প্রেম নিবেদন করুক, ভালোবাসি কথাটা কানে শুনতে না পেলেও সরাসরি চোখে দেখার তৃপ্তি থেকে সে কিছুতেই বঞ্চিত হবে না আজ। আর তাই অর্ককে ডেকে এনেছে সে। আঙুলের বিশেষ কায়দায় অর্ককে প্রশ্ন করে,     

- কি ?... প্রপোজ করবে ? নাকি.......

অর্ক থমকায় এক মুহূর্ত। চারপাশটা দেখে নেয় এক নজর। কেউ বিশেষ লক্ষ্য করছে না। স্মিত হেসে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে । হাঁটুমুড়ে বসে পড়ে পাখির পায়ের কাছে। চোখে চোখ রেখে দু হাতের আঙুলের ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলে অনুপম অভিব্যক্তি.........

'আমায় ক্ষমা কোরো, আমি এটুকু বলতে সামান্য দেরি করে ফেললাম। আমার অতীত ও বর্তমানে একটাই তফাৎ জানো....., একটায় তুমি ছিলেনা, আর অন্যটায় তুমি আছ। তোমার সান্নিধ্যে যে প্রগাঢ় শান্তি পেয়েছি, এই জীবনে আমার জন্য তা অনেকখানি। আমার সমস্ত সত্ত্বা ও আত্মার সাথে জড়িয়ে আছ শুধু তুমি, কারণ তোমাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি.............পাখি চৌধুরী, তুমি কি আমার চিরসাথী হবে' ? 

পাখির চোখ দিয়ে ফল্গুধারার মতো নেমে আসে আনন্দাশ্রু। দু হাতে সে মুখ ঢেকে নেয় তৎক্ষণাৎ।   
     
কফিশপের সমস্ত লোকজন, যাঁরা এ যাবৎ পাখি অর্কর মধ্যে অঙ্গুলিহেলনে বলা টুকরো কথাবার্তাগুলো না বোঝার ফলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন, তারা অর্ককে হাঁটু মুড়ে বসতে দেখে ও পাখির অনুরূপ আবেগ আন্দাজ করে সোল্লাস করে ওঠেন। ঘর জুড়ে বয়ে যায় হর্ষধ্বনি ও হাততালির বন্যা। কেউ কেউ এসে পাখি আর অর্ককে শুভেচ্ছা জানিয়ে যায়। কফিশপ থেকে কমপ্লিমেন্টারি কেকের ব্যবস্থা করা হয়। 

অর্ক আর পাখি কোনোদিকে খেয়াল করে না। দুজনে স্বপ্নাবিষ্টের মতো চেয়ে থাকে দুজনের দিকে। গোধূলির স্বর্ণালী আভা কাঁচের জানলা ভেদ করে টেবিল ছাপিয়ে রাঙিয়ে দিয়ে যায় দুজনের চোখমুখ........লজ্জাবনত পাখি ধীরে ধীরে মিশে যায় অর্কর বুকে ।


অলংকরণ : অর্ণব দাশগুপ্ত 

 #bengalilovestories #bengalishortstories #bengaliromanticstories

Friday, May 5, 2017

অনুপদ্য - ১২

অবদমিত ইচ্ছেরা প্রতিশ্রুতি হারায়
শরীর জুড়ে বয়ে চলে কালবৈশাখী টান
অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজুক শহর বরং.....
বেপরোয়া সময়ে বাজুক দিনবদলের গান


ছবি : নিজস্ব 














#bengali #bengalipoems #bengalipoetries