Wednesday, February 15, 2017

সাপ্তাহিকী ২৩ # ছোট্ট প্রেমের গল্প

ভ্যালেনটাইন্স ডের সকালবেলায় ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল শুভেন্দুর। বাঁ হাত দিয়ে বালিশের তলা থেকে মোবাইলটা বের করে নিয়ে চোখের সামনে ধরে। স্ক্রিনের ওপর অপর্ণার নামটা জ্বলছে নিভছে। কি আশ্চর্য ! এতো সকাল সকাল তো ফোন আসেনা। কিছু হলো নাকি ? কল রিসিভ করে ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে, 'হ্যাঁ বলো......., এই সময় হঠাৎ' ?
ওদিক থেকে অপর্ণার থমথমে কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়। 
- তুমি একটু চট করে রেডি হয়ে নিয়ে বেরোতে পারবে ? 
-  কেন, কি হয়েছে ?
- বাড়িতে সমস্যা হচ্ছে খুব, একটা ডিসিশন নিতে হবে, ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসতে পারবে কি ?
ঘুম কেটে যায় শুভেন্দুর। ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসে। অপর্ণার বাড়িতে গত কয়েকদিন ধরেই সমস্যা চলছে, শুভেন্দু জানে সেটা। নিশ্চই বড় রকমের কোনো ঝামেলা হয়েছে আজ, নাহলে ধীর স্থির অপর্ণা এতো তাড়াহুড়ো করার মানুষ নয়। সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, 'আচ্ছা বেশ, বেরোচ্ছি, কোথায় আসতে হবে বলো' ? 'গোলপার্ক.......মৌচাকের সামনে', বলে ফোনটা কেটে দেয় অপর্ণা। 

অপর্ণা শুভেন্দুর আলাপ হয় একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। প্রায় বছর দুয়েক আগে কোনো এক জ্যোৎস্না ভরা হেমন্তের রাত্রে। প্রথম পরিচয় থেকে পরবর্তী আলাপচারিতা গাঢ় হতে সময় নেয়নি বেশি। দুজন সমমনস্ক মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব ঘুচে যাওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। স্বাভাবিক নিয়মে ভালোলাগার রূপান্তর ঘটেছিলো ভালোবাসায়। 'ভালোবাসি' বলতে হয়নি কাউকেই, বরং পরিণত অনুরাগ ও আবেগের বন্ধনে অজান্তেই কাছাকাছি চলে এসেছিলো দুজনে। অপর্ণার ভালো লেগেছিলো শুভেন্দুর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। জীবনের সহজ সরল উপলব্ধি মুগ্ধ করেছিল অপর্ণাকে। শুভেন্দুকে টেনেছিল অপর্ণার স্বাধীনচেতা মনোভাব। যে কোনো জটিল পরিস্থিতি খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অপর্ণা, আশ্চর্য দক্ষতায় মানিয়ে নেয় ছোট ছোট চড়াই উতরাইয়ের মুহূর্তগুলো। সময়ের উজান বেয়ে ভেসে বেড়িয়েছিল দুজনে হাত ধরাধরি করে। বলাই বাহুল্য এই সম্পর্কের আঁচ দুজনের বাড়ি অবধি পৌঁছেছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। দুর্ভাগ্যবশত কোনো বাড়িই এদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। শুভেন্দুর বাড়িতে দারুন গোলযোগ না হলেও অপর্ণার বাড়িতে দুর্ভোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিলো অচিরেই। পরিস্থিতি কণ্টকময় হয়ে এসেছিলো ক্রমশ আর তাই অপর্ণার এই জরুরি তলব। 

নির্দিষ্ট সময় গোলপার্কে চলে আসে শুভেন্দু। দূর থেকে হাত নেড়ে ডেকে নেয় অপর্ণা। 
- ব্রেকফাস্ট করোনি নিশ্চই ?
- নাহ, তুমি এতো তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালে, কোনোরকমে স্নানটা সেরেই বেরিয়ে এসেছি। কি ব্যাপার বলো তো ?
- বলছি, চলো, তার আগে একটু পেটে কিছু দিয়ে নি। আমারও সকাল থেকে খাওয়া হয়নি কিছু। 

দুজনে আনন্দ কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। দুটো ডিম্ টোস্ট আর চা অর্ডার করে গুছিয়ে বসে। শুভেন্দু জিজ্ঞেস করে, 'তুমি আজ কলেজ যাবে না' ? অপর্ণা গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলে, 'নাহ, আজ দুটো মাত্র লেকচার ছিল, আসবো না বলে দিয়েছি, তেমন অসুবিধে হবে না'। শুভেন্দু অপর্ণার হাতে হাত রাখে। জিজ্ঞেস করে, 'বাড়িতে কি খুব সমস্যা হচ্ছে' ?

- হ্যাঁ, বাড়িতে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কাল রাতে বিশ্রী ঝামেলা হয়েছে। কেউই এই সম্পর্কটা মেনে নিতে পারছে না। 
- তুমি কি চাইছ ?
- তোমার সাথে থাকতে চাইছি, ব্যাস এটুকুই।

অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শুভেন্দু। পূর্ব দিকের জানলা দিয়ে কড়ামিঠে রোদ এসে পড়েছে অপর্ণার গালে। অদ্ভুত দ্যুতিময় লাগে মুখের চারপাশটা। তৃপ্তিতে শুভেন্দুর গলা বুজে আসে। অপর্ণার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, 'আমার বাড়িতেও যে কম সমস্যা নেই সে তো তোমার অজানা নয় অপা, তাহলে............'। 
- আমি জানি, আর তাই সমস্ত দিক ভেবে একরকম ঠিক করেই এসেছি। 
'কি রকম' ? সন্দিহান হয় শুভেন্দু। 
- যাদবপুরের দিকে একটা দুকামরার ফ্ল্যাট আছে। মেন রোড থেকে সামান্য ভিতরে। আমার কলেজের কলিগের থেকে খবরটা পেয়েছি। ইনফ্যাক্ট ওরই যোগসূত্রে ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে কথা হয়েছে কাল। আমাদের দুজনের স্বচ্ছন্দে হয়ে যাবে মনে হয়। একবার দেখতে যাবে ?  
- কত দাম চাইছে ?
- লাখ বিশেকের মধ্যেই। আমার জমানো যা টাকা আছে তাতে ডাউন পেমেন্টটা করে দিতে পারবো। বাকিটা লোন নিয়ে নেব। কি বলো ?
শুভেন্দু আমতা আমতা করে বলে, 'সে নাহয় হলো। কিন্তু আমাকে তো লোন দেবে না কেউ। আমার তো চাকরি নেই, তুমি জানো'।
- আমার তো আছে, আর তাই লোনটা আমার নামেই নেব। ওটা নিয়ে ভেবো না। 
- তা কি করে হয়। সমস্ত টাকাটাই তুমি দিচ্ছ, আমার ওপরেও তো কোনো দায়িত্ত্ব বর্তায়, নাকি ?

শুভেন্দুর কাঁচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে অপর্ণা। বলে, 'বেশ তো, রোজের বাজারটা কোরো আর সারা মাসের আনুষাঙ্গিক খরচগুলো তুমিই নাহয় দিও, কেমন ? স্মিত হাসে শুভেন্দু। ভেবে পায়না কি বলবে। অপর্ণার এমন আকস্মিক সিদ্ধান্তে বিমূঢ় হয়ে যায় কিছুটা। অথচ অপর্ণা যা বলছে, যা করছে তা সমস্ত দিক ভেবেই করছে, এছাড়া আর সত্যিই কোনো উপায় নেই, শুভেন্দু জানে সে কথা। ইদানীং দুতরফেরই বাড়ির পরিস্থিতি বিষময় হয়ে উঠেছে । নিত্যদিনের বিষোদ্গীরণ বড় বুকে বাজে। সেকথা কাউকে বলবার নয়, কাউকে বোঝানোর নয়। একমাত্র অপর্ণা জানে। জীবনের তপ্ত মরুপ্রান্তরে অপর্ণাই একমাত্র মরুদ্যান তার কাছে। হৃদস্পন্দনের অন্যতম বলিষ্ঠ কারণ। নানারকম ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায় শুভেন্দু। অপর্ণার ছোঁয়ায় চটক ভাঙে। 

- কি এতো ভাবছো শুভ ?
- না....., তেমন কিছু নয় ........
- আমি জানি, বাড়ির লোকজনদের ছেড়ে থাকাটা বড় কঠিন কাজ। সে কাজ করতে তোমায় জোর করবো না আমি। আর তাছাড়া আমার মতে যে তোমাকে চলতে হবেই এমন কোনো কথা নেই। তেমন হলে তুমি দুদিন ভাবার সময় নাও। ফ্ল্যাট তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তারপরেও যদি তোমার আপত্তি থাকে, জেনো, আমি বিন্দুমাত্র কিছু মনে করবো না। আমি শুধু তোমায় পেতে চেয়েছি শুভ, নিজের মতো করে, কিন্তু তোমার অমতে নয়। 
- ওকথা বোলো না অপা, আমি কি তোমার ভেতরটা পড়িনি ভাবছো ? আমায় ভুল বুঝো না, একসাথে পথচলার সংকল্প করেছি যখন, পিছিয়ে আসার ভণ্ডামি আমার সইবে না। ওতে যে মরেও সুখ পাবো না। 

শুভেন্দুর দুগাল বেয়ে অব্যক্ত বুকচাপা স্রোত নেমে আসে। অপর্ণা শক্ত করে হাত দুটো চেপে ধরে শুভেন্দুর। শুভেন্দু চোখ নামিয়ে বলে, 'শুধু একটাই আফশোষ থাকবে জানো,..............' 
- কি ?
- দাদুভাইকে রোজ দেখতে পাবো না.........

অপর্ণা নির্বাক বসে থাকে। বুকের ভেতরটা বেদনায় মুচড়ে ওঠে। ষাটোর্দ্ধ মানুষটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। তার নিজের নাতি নাতনি নেই বটে, তবু সংসারের মায়া যে কতবড় নাগপাশ এ তার থেকে ভালো আর কেউই জানে না। বিয়ের পর পরই স্বামী দেহত্যাগ করে। কলেজে চাকরি করে একমাত্র মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিয়েছে আজ অনেক বছর। সেও তার স্বামীকে নিয়ে অপর্ণার কাছেই থাকে। বিপত্নীক শুভেন্দুর সাথে ঘনিষ্ঠতা মেয়ে জামাই মেনে নিতে পারেনি ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়ে। শুভেন্দুর বাড়িতেও তার একমাত্র সন্তান ও বৌমার মুখের ভাষা লাগাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। রিটায়ার্ড বাবার একা থাকার পরিনাম যে পরিণয়তেও শেষ হতে পারে একথা চিন্তা করা তাদের কাছে আত্মহত্যা করার সামিল। সে সংসারের একমাত্র সূক্ষ্ম যোগ শুভেন্দুর দুবছরের আদরের নাতি, যার আধো আধো গলায় দাদু শব্দটায় স্বর্গ খুঁজে পায় শুভেন্দু। সুতরাং কয়েক মাস ধরে দুজনকেই অন্যত্র স্থায়ী ঠিকানার কথা ভাবতে হয়েছে। আজ সে সন্ধিক্ষণ আগত প্রায়। শুভেন্দুর সামলে উঠতে ক্ষণিক সময় লাগে। তবুও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে। অপর্ণা জিজ্ঞেস করে, 'বাড়ি যাবে তো ? ট্যাক্সি ডেকে দিই' ? 

শুভেন্দু মাথা নাড়ে দুদিকে। দৃঢ়কণ্ঠে বলে, 'ট্যাক্সি ডাকো, তবে বাড়ি নয়, যাদবপুর যাব............ফ্ল্যাটটা দেখে নিতে হবে তো ঠিকঠাক করে......... '


অলংকরণ : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalilovestories #bengaliromanticstories #love #romance #saptahiki

Monday, February 6, 2017

জন্মান্তর

জন্মাবধি শুনিয়াছি ভালো ছেলে হইতে হইবে। ভালো ছেলের যে প্রকৃত অর্থ কি তাহা বুঝিয়া উঠিতে সময় লাগিয়াছিল অনেক। যতদিনে বুঝিয়াছিলাম ততদিনে ছেলে হইয়া উঠিয়াছিলাম রীতিমতো, ভালো হইয়াছিলাম কিনা জানি না। ছোট থাকিতে অনেকেই জিজ্ঞাসা করিত, 'বড় হইয়া তুমি কি হইতে চাও খোকা' ? কোনোপ্রকারেই গুছাইয়া বলিতে পারিতাম না। গুছাইয়া বলিবার শিল্পটা রপ্ত করিতে পারি নাই তখন, ফলতঃ অধিকাংশ সময়ই না বলা কথাগুলি গলার কাছে আসিয়া আটকা পড়িত, কিছুতেই শব্দের পর শব্দ বসাইয়া বলিয়া উঠিতে পারিতাম না। প্রশ্নকর্তার বা কর্ত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতাম ফ্যালফ্যাল করিয়া। তিনি অবোধ বালক বলিয়া করুণা করিতেন, ভাবিতেন বোধহয় কথাই ফুটিয়া ওঠেনি, ও বেচারা এই কঠিন প্রশ্নের কি উত্তর দিবে। প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ায় জন্মদাত্রী রক্তচক্ষু হানিতেন আমার উপর। ভাবিতেন এ সমস্তই আমার ছল চাতুরি, কচি মাথার শয়তানি। জনসমক্ষে কথা না কহিয়া ওনাকে ছোট করিবার ফিকির খুঁজিয়া ফিরিতেছি।

কিন্তু সত্য ঘটনা তাহা নহে। সত্যটি হইল, আমি বড় হইতেই চাহিতাম না। তাহার অর্থ এই নহে যে বড় হইবার সমস্ত রকম ক্ষতিকর দিকগুলি আমার জানা ছিল । না....... বরং স্কুলে যাইয়া বন্ধুদের সাথে চরম দুরন্তপনা করা বা বাড়ি ফিরিয়া পশ্চিমের মাঠে ক্রিকেট বা ফুটবল পেটানো আমার যারপরনাই মনোরম লাগিত। কিয়দংশ হইলেও মনে মনে বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে বড় হইয়া কাঁধে ব্যাগ লইয়া সকাল সকাল অফিস যাইতে হইবে। যতক্ষণে ফিরিয়া আসিব বিকাল গড়াইয়া সন্ধ্যে হইবে, মাঠ অন্ধকার হইয়া আসিবে, খেলাধুলা হইবে না। সুতরাং বড় হইবার তেমন প্রয়োজন বোধ করিতাম না। আর তাই এই কারণেই সেসব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে চাহিতাম না। জানিতাম লোকসমাজে হাস্যস্পদ হইব, মা জোর কানমলা দিবেন, কেননা যে ছেলের বড় হইবার কোনো সাধ নাই সে ছেলের অদূর ভবিষ্যৎ যে ঘন কৃষ্ণ কালিমালিপ্ত হইবে এ আর নুতন কথা কি। তাই চুপ করিয়া থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করিতাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পার পাইয়া যাইতাম, কিছু ক্ষেত্রে পারিতাম না। তাঁহারা মাকে বলিতেন, 'তোমার ছেলেটি বড় কম কথা বলে, চারটে প্রশ্ন করিলে একটির উত্তর দেয়, দু দণ্ড বসিয়া যে আলাপ করিব তার জো নাই, সর্বক্ষণ পালাই পালাই করিতেছে'। মা ব্যর্থ হাসিতেন, বলিতেন, 'ও একটু লাজুক আছে, দুদিন যাক আপনিই আলাপ জমাবে'। কথাটা সত্য। সে মানুষ যদি আলাপ জমানোর মত হইত আমি নিজে নিজেই জমাইয়া লইতাম, কিন্তু তা যদি না হইত পারতপক্ষে এড়াইয়া চলিতাম। সে জন্য অবশ্য তাঁহারা কটাক্ষ করিতে ছাড়িতেন না, জনান্তিকে বলিতেন, 'ও ছোঁড়ার বড্ড দেমাক, মাটিতে পা পড়ে না, মিশিতে জানে না'। এ অপবাদ অবশ্য আমার অর্ধাঙ্গিনীও দিয়ে থাকেন। তাহাকে বুঝাইয়া উঠিতে পারিনা যে কম কথার মানুষও পৃথিবীতে বাঁচে, যাঁহারা বেশি কথা বলেন তাঁহাদের মতো করিয়াই। কিন্তু সফল হই নাই এ অবধি।

বেশ মনে পড়ে ছোটবেলায় বন্ধুরা আলোচনা করিতাম, যে, পরজন্মে যদি আবার এ ধরণীতে আসিবার সুযোগ পাই তাহা হইলে কি হইয়া জন্মিব। নানা রকম বলিত সকলে, কেউ বলিত গাঙচিল, কেউ বলিত প্রজাপতি, কেউ বলিত বাঘ, কেউ বলিত হাঙর। আমি ভাবিয়া কুলকিনারা পাইতাম না। পুনঃ পুনঃ মনে হইত মানব জনম লইয়া তো দেখা হইয়া গিয়াছে, তাহা হইলে কি এমন হওয়া যায়, যাহা করিয়া দিব্যি হাসিয়া খেলিয়া দিন কাটাইয়া দেওয়া যাইতে পারে। প্রথমে ভাবিতাম গরু হইলে বেশ হয়। মা শুনিলে বলিত ও আর কষ্ট করিয়া হইবার কি আছে। তবুও এই প্রাণীটির উপর ভারি মায়া হয় আমার।  বেচারা সারাদিন মাঠে লাঙল চষিয়া গোয়ালঘরে ঝিম মারিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া জাবনা চিবাইতে থাকে। অবশ্য তাহার পরেই সকাল বেলার দুধ দোয়ার অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়া সে ভাবনার কথা ত্যাগ করিয়াছিলাম। পরে ভাবিয়া দেখিয়াছি চতুষ্পদ জীব হইতে গেলে নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হইবে। খেয়াল খুশিমতো নানাবিধ কাজ করা যাইতে পারলেও দু চার ঘা খাইবার ভয়ও যথেষ্ট থাকে। তদুপরি মনে হইত, মানুষ ছাড়া সকল জীবজন্তুই মনের মতো করিয়া জীবন অতিবাহিত করে, একমাত্র মানুষই এক অদৃশ্য শৃঙ্খল বেষ্টিত হইয়া ঘুরিতেছে। তাহা হইলে সকল রকম জীব হইয়া এক একবার করিয়া জন্মিতে পারিলে বেশ হয়। বলিতে বাধা নাই সে ভাবনা এখনো মনের মধ্যে জীবিত আছে। সযত্নে তাহাকে লালন পালন করিয়া রাখিয়াছি। 

সুযোগ পাইলেই প্রথমে মৎস্য দিয়া শুরু করিব। একেবারে পুরাণের মৎস্য অবতারের মতো কিয়দটা। তারপর কূর্ম , বরাহ , নরসিংহ অবধি গিয়া থামিয়া যাইতে হইবে। তাহার কারণ হইল এই, যে এর পরেই বামন অবতার, সেটা হইলেই চাঁদে হাত বাড়াইবার স্বপ্ন দেখিতে শুরু করিব পুনরায়। আবার সেই ঘূর্ণিজলের মধ্যে পড়িয়া যাওয়া। আবার মানব ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সে আমার দ্বারা হইবে না। অতএব দেখিয়া বুঝিয়া জন্মিতে হইবে। সামান্য গাফিলতি হইয়াছে কি সংশোধনের অবকাশটুকু পাইব না। বিদ্বজনেরা এতক্ষনে আমার মুণ্ডপাত করিতেছেন হয়ত। হয়ত ভাবিতেছেন ছোঁড়াটার মাথাটা একেবারে গিয়াছে। মানুষ হইয়া জন্মানো যে কত বড় পুণ্যের কাজ, কত জন্ম জন্মান্তরে, কত যুগ শতাব্দী ধরে যে এ দুর্ভেদ্য বাধা পেরিয়ে আসিতে হয় তাহা আর তোমার মতো নরপাতক বুঝিবে কি করিয়া ? তা বটে, তবে বিশ্বাস করুন কত্তা, ও আর আমি বুঝিতে চাই না। বেশি বুঝিতে গেলে গোলমাল বাধে, ঝাপসা হইয়া ওঠে চতুর্দিক, শেষটায় নিদ্রা পায়। মুহুর্মুহু হাই তুলিতে থাকি। তাই জাগিয়া থাকিতে গেলে ওসব বাঁকা কথা চিন্তা করিতে সাহস পাই না। জন্মের আরও একটি বছর পার হওয়ার পর শুধু এই কথাটি ভাবিতে থাকি, মানব জন্ম হইল বটে তবে মনুষ্যোচিত কাজ করিতে পারিলাম কি। কি জানি। আপনাদেরও বলি, পরজন্মে কি হইতে চাহেন সেইটে আমাকে জানান দয়া করিয়া। দেখিয়া বুঝিয়া একটি পছন্দ করিয়া লইতে হইবে। সেইমতো ঈশ্বরকে আগাম জানাইয়া রাখিব, কি বলেন ?

পুনশ্চ : যাঁরা জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন তাঁদের সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।

ছবি : গুগল 

#bengaliarticles #birthdaywriteups #bengaliwriteups