ভ্যালেনটাইন্স ডের সকালবেলায় ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল শুভেন্দুর। বাঁ হাত দিয়ে বালিশের তলা থেকে মোবাইলটা বের করে নিয়ে চোখের সামনে ধরে। স্ক্রিনের ওপর অপর্ণার নামটা জ্বলছে নিভছে। কি আশ্চর্য ! এতো সকাল সকাল তো ফোন আসেনা। কিছু হলো নাকি ? কল রিসিভ করে ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে, 'হ্যাঁ বলো......., এই সময় হঠাৎ' ?
ওদিক থেকে অপর্ণার থমথমে কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়।
ওদিক থেকে অপর্ণার থমথমে কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়।
- তুমি একটু চট করে রেডি হয়ে নিয়ে বেরোতে পারবে ?
- কেন, কি হয়েছে ?
- বাড়িতে সমস্যা হচ্ছে খুব, একটা ডিসিশন নিতে হবে, ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসতে পারবে কি ?
ঘুম কেটে যায় শুভেন্দুর। ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসে। অপর্ণার বাড়িতে গত কয়েকদিন ধরেই সমস্যা চলছে, শুভেন্দু জানে সেটা। নিশ্চই বড় রকমের কোনো ঝামেলা হয়েছে আজ, নাহলে ধীর স্থির অপর্ণা এতো তাড়াহুড়ো করার মানুষ নয়। সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, 'আচ্ছা বেশ, বেরোচ্ছি, কোথায় আসতে হবে বলো' ? 'গোলপার্ক.......মৌচাকের সামনে', বলে ফোনটা কেটে দেয় অপর্ণা।
অপর্ণা শুভেন্দুর আলাপ হয় একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। প্রায় বছর দুয়েক আগে কোনো এক জ্যোৎস্না ভরা হেমন্তের রাত্রে। প্রথম পরিচয় থেকে পরবর্তী আলাপচারিতা গাঢ় হতে সময় নেয়নি বেশি। দুজন সমমনস্ক মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব ঘুচে যাওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। স্বাভাবিক নিয়মে ভালোলাগার রূপান্তর ঘটেছিলো ভালোবাসায়। 'ভালোবাসি' বলতে হয়নি কাউকেই, বরং পরিণত অনুরাগ ও আবেগের বন্ধনে অজান্তেই কাছাকাছি চলে এসেছিলো দুজনে। অপর্ণার ভালো লেগেছিলো শুভেন্দুর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। জীবনের সহজ সরল উপলব্ধি মুগ্ধ করেছিল অপর্ণাকে। শুভেন্দুকে টেনেছিল অপর্ণার স্বাধীনচেতা মনোভাব। যে কোনো জটিল পরিস্থিতি খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অপর্ণা, আশ্চর্য দক্ষতায় মানিয়ে নেয় ছোট ছোট চড়াই উতরাইয়ের মুহূর্তগুলো। সময়ের উজান বেয়ে ভেসে বেড়িয়েছিল দুজনে হাত ধরাধরি করে। বলাই বাহুল্য এই সম্পর্কের আঁচ দুজনের বাড়ি অবধি পৌঁছেছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। দুর্ভাগ্যবশত কোনো বাড়িই এদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। শুভেন্দুর বাড়িতে দারুন গোলযোগ না হলেও অপর্ণার বাড়িতে দুর্ভোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিলো অচিরেই। পরিস্থিতি কণ্টকময় হয়ে এসেছিলো ক্রমশ আর তাই অপর্ণার এই জরুরি তলব।
নির্দিষ্ট সময় গোলপার্কে চলে আসে শুভেন্দু। দূর থেকে হাত নেড়ে ডেকে নেয় অপর্ণা।
- ব্রেকফাস্ট করোনি নিশ্চই ?
- নাহ, তুমি এতো তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালে, কোনোরকমে স্নানটা সেরেই বেরিয়ে এসেছি। কি ব্যাপার বলো তো ?
- বলছি, চলো, তার আগে একটু পেটে কিছু দিয়ে নি। আমারও সকাল থেকে খাওয়া হয়নি কিছু।
দুজনে আনন্দ কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। দুটো ডিম্ টোস্ট আর চা অর্ডার করে গুছিয়ে বসে। শুভেন্দু জিজ্ঞেস করে, 'তুমি আজ কলেজ যাবে না' ? অপর্ণা গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলে, 'নাহ, আজ দুটো মাত্র লেকচার ছিল, আসবো না বলে দিয়েছি, তেমন অসুবিধে হবে না'। শুভেন্দু অপর্ণার হাতে হাত রাখে। জিজ্ঞেস করে, 'বাড়িতে কি খুব সমস্যা হচ্ছে' ?
- হ্যাঁ, বাড়িতে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কাল রাতে বিশ্রী ঝামেলা হয়েছে। কেউই এই সম্পর্কটা মেনে নিতে পারছে না।
- তুমি কি চাইছ ?
- তোমার সাথে থাকতে চাইছি, ব্যাস এটুকুই।
অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শুভেন্দু। পূর্ব দিকের জানলা দিয়ে কড়ামিঠে রোদ এসে পড়েছে অপর্ণার গালে। অদ্ভুত দ্যুতিময় লাগে মুখের চারপাশটা। তৃপ্তিতে শুভেন্দুর গলা বুজে আসে। অপর্ণার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, 'আমার বাড়িতেও যে কম সমস্যা নেই সে তো তোমার অজানা নয় অপা, তাহলে............'।
- আমি জানি, আর তাই সমস্ত দিক ভেবে একরকম ঠিক করেই এসেছি।
'কি রকম' ? সন্দিহান হয় শুভেন্দু।
- যাদবপুরের দিকে একটা দুকামরার ফ্ল্যাট আছে। মেন রোড থেকে সামান্য ভিতরে। আমার কলেজের কলিগের থেকে খবরটা পেয়েছি। ইনফ্যাক্ট ওরই যোগসূত্রে ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে কথা হয়েছে কাল। আমাদের দুজনের স্বচ্ছন্দে হয়ে যাবে মনে হয়। একবার দেখতে যাবে ?
- কত দাম চাইছে ?
- লাখ বিশেকের মধ্যেই। আমার জমানো যা টাকা আছে তাতে ডাউন পেমেন্টটা করে দিতে পারবো। বাকিটা লোন নিয়ে নেব। কি বলো ?
শুভেন্দু আমতা আমতা করে বলে, 'সে নাহয় হলো। কিন্তু আমাকে তো লোন দেবে না কেউ। আমার তো চাকরি নেই, তুমি জানো'।
- আমার তো আছে, আর তাই লোনটা আমার নামেই নেব। ওটা নিয়ে ভেবো না।
- তা কি করে হয়। সমস্ত টাকাটাই তুমি দিচ্ছ, আমার ওপরেও তো কোনো দায়িত্ত্ব বর্তায়, নাকি ?
শুভেন্দুর কাঁচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে অপর্ণা। বলে, 'বেশ তো, রোজের বাজারটা কোরো আর সারা মাসের আনুষাঙ্গিক খরচগুলো তুমিই নাহয় দিও, কেমন ? স্মিত হাসে শুভেন্দু। ভেবে পায়না কি বলবে। অপর্ণার এমন আকস্মিক সিদ্ধান্তে বিমূঢ় হয়ে যায় কিছুটা। অথচ অপর্ণা যা বলছে, যা করছে তা সমস্ত দিক ভেবেই করছে, এছাড়া আর সত্যিই কোনো উপায় নেই, শুভেন্দু জানে সে কথা। ইদানীং দুতরফেরই বাড়ির পরিস্থিতি বিষময় হয়ে উঠেছে । নিত্যদিনের বিষোদ্গীরণ বড় বুকে বাজে। সেকথা কাউকে বলবার নয়, কাউকে বোঝানোর নয়। একমাত্র অপর্ণা জানে। জীবনের তপ্ত মরুপ্রান্তরে অপর্ণাই একমাত্র মরুদ্যান তার কাছে। হৃদস্পন্দনের অন্যতম বলিষ্ঠ কারণ। নানারকম ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায় শুভেন্দু। অপর্ণার ছোঁয়ায় চটক ভাঙে।
- কি এতো ভাবছো শুভ ?
- না....., তেমন কিছু নয় ........
- আমি জানি, বাড়ির লোকজনদের ছেড়ে থাকাটা বড় কঠিন কাজ। সে কাজ করতে তোমায় জোর করবো না আমি। আর তাছাড়া আমার মতে যে তোমাকে চলতে হবেই এমন কোনো কথা নেই। তেমন হলে তুমি দুদিন ভাবার সময় নাও। ফ্ল্যাট তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তারপরেও যদি তোমার আপত্তি থাকে, জেনো, আমি বিন্দুমাত্র কিছু মনে করবো না। আমি শুধু তোমায় পেতে চেয়েছি শুভ, নিজের মতো করে, কিন্তু তোমার অমতে নয়।
- ওকথা বোলো না অপা, আমি কি তোমার ভেতরটা পড়িনি ভাবছো ? আমায় ভুল বুঝো না, একসাথে পথচলার সংকল্প করেছি যখন, পিছিয়ে আসার ভণ্ডামি আমার সইবে না। ওতে যে মরেও সুখ পাবো না।
শুভেন্দুর দুগাল বেয়ে অব্যক্ত বুকচাপা স্রোত নেমে আসে। অপর্ণা শক্ত করে হাত দুটো চেপে ধরে শুভেন্দুর। শুভেন্দু চোখ নামিয়ে বলে, 'শুধু একটাই আফশোষ থাকবে জানো,..............'
- কি ?
- দাদুভাইকে রোজ দেখতে পাবো না.........
অপর্ণা নির্বাক বসে থাকে। বুকের ভেতরটা বেদনায় মুচড়ে ওঠে। ষাটোর্দ্ধ মানুষটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। তার নিজের নাতি নাতনি নেই বটে, তবু সংসারের মায়া যে কতবড় নাগপাশ এ তার থেকে ভালো আর কেউই জানে না। বিয়ের পর পরই স্বামী দেহত্যাগ করে। কলেজে চাকরি করে একমাত্র মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিয়েছে আজ অনেক বছর। সেও তার স্বামীকে নিয়ে অপর্ণার কাছেই থাকে। বিপত্নীক শুভেন্দুর সাথে ঘনিষ্ঠতা মেয়ে জামাই মেনে নিতে পারেনি ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়ে। শুভেন্দুর বাড়িতেও তার একমাত্র সন্তান ও বৌমার মুখের ভাষা লাগাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। রিটায়ার্ড বাবার একা থাকার পরিনাম যে পরিণয়তেও শেষ হতে পারে একথা চিন্তা করা তাদের কাছে আত্মহত্যা করার সামিল। সে সংসারের একমাত্র সূক্ষ্ম যোগ শুভেন্দুর দুবছরের আদরের নাতি, যার আধো আধো গলায় দাদু শব্দটায় স্বর্গ খুঁজে পায় শুভেন্দু। সুতরাং কয়েক মাস ধরে দুজনকেই অন্যত্র স্থায়ী ঠিকানার কথা ভাবতে হয়েছে। আজ সে সন্ধিক্ষণ আগত প্রায়। শুভেন্দুর সামলে উঠতে ক্ষণিক সময় লাগে। তবুও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে। অপর্ণা জিজ্ঞেস করে, 'বাড়ি যাবে তো ? ট্যাক্সি ডেকে দিই' ?

