
মাথার পিছনে একটা অদ্ভুত ব্যাথা হচ্ছে নিখিলেশের । সাধারণ মাথাধরা নয়। একনাগাড়ে একটানাও নয়। থেমে থেমে ধীর লয়ে ব্যাথাটা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ভারী কিছু একটা জিনিস দিয়ে অল্প অল্প চাপ দিচ্ছে পিছন থেকে। গতকাল রাতে ঘুমের ওষুধটা খাওয়ার পর থেকেই যেন শুরু হয়েছিল। অতটা পাত্তা না দিয়ে নিয়মমাফিক খানিক্ষন টিভি দেখেই শুয়ে পড়েন নিখিলেশ। ভেবেছিলেন ভালো ঘুম হলেই কেটে যাবে। অথচ সকালে উঠেও ব্যাথাটা দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে। ভারী মুস্কিলে পড়লেন, সারাদিন ধরে এই বেয়াড়া ব্যাথাটা যদি পাথরের মতো বয়ে বেড়াতে হয় তাহলেই তো হয়েছে। অফিসের কাজ তো গোল্লায় যাবে। বেসরকারী অফিসে হিসাব রক্ষকের কাজ তো কম ঝক্কির নয়। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই বড় রকমের ঝামেলা পোয়াতে হবে তখন। পেশাগত দক্ষতায় এত বছরের কর্মময় জীবনে খুব একটা গলদ তাঁর হয়নি কখনো। তবুও শারীরিক দুর্বলতার কারণে হিসেবের গরমিল, মোটেও কাজের কথা নয়। তার ওপর অফিসের নতুন ম্যানেজার একাধারে বেশ দাপুটে এবং বাচাল। ছোটখাটো সমস্যাতেও লঘু গুরু জ্ঞান করেন না কখনো। দু চার কথা শুনিয়ে দেবার সুযোগ খোঁজেন যেন সবসময়। এই তো দুদিন আগে, মান্থলি মিটিংয়ে, জনসংযোগ দপ্তরের এক জুনিয়র কলিগকে যাচ্ছেতাই কথা শোনালেন সবার সামনে, শুধুমাত্রই একটা ভুল মেল্ টাইপ করেছেন বলে। নিরীহ, মিতভাষী নিখিলেশ ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হলেও প্রতিবাদটা এড়িয়ে গেছেন ইচ্ছে করে। ঝামেলা ঝঞ্ঝাট পারতপক্ষে সহ্য হয় না তাঁর। আর তাছাড়া আর তো তিন চার বছর বাকি । তারপরেই অখণ্ড বেহিসেব অবসর। শেষের এই বছরগুলো যতটা শান্তিতে কাটানো যায় ততই মঙ্গল। খামোকা তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না করাই ভালো।
মাথার পেছনটা আবার টনটন করে ওঠে। ঘাড় কাত করে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে নেন নিখিলেশ। নাহ, অফিস ফেরত একবার মনোময় ডাক্তারের চেম্বার থেকে ঘুরে আসতে হবে। বেশি বাড়াবাড়ি হলে আবার বিপদ আছে। একলা মানুষ নিখিলেশ। বিয়ে থা করেন নি। পৈতৃক বাড়িটায় ভূতের মতন একাই থাকেন। অনেক ছোট বয়েসে বাবা মারা যান। আর তিরিশ বছর বয়েসে মা ও চলে যান কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে। মাকে খুবই ভালোবাসতেন নিখিলেশ। মা মারা যাওয়ার পর পরই নিখিলেশ অস্বাভাবিক রকমের অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। কোনো এক অজানা কারণে লোকজনের সাথে মেলামেশা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছিল। প্রায় এক বছর উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন এদিক ওদিক। মুম্বই, দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর চরকিপাক খেয়েছেন শুধু। সেসময় এরকমই একটা মাথাব্যথা হতো, বেশ মনে আছে । আত্মীয় স্বজনরা কানাঘুষো বলত, নিখিলেশের নাকি মানসিক রোগ হয়েছে, কারণ নিখিলেশ মাঝে মাঝেই এমন অদ্ভুত উগ্র আচরণ করতেন যার কোনো সহজ স্বাভাবিক ব্যাখ্যা পাওয়া যেত না। ডাক্তার, মনোবিদ সমস্তরকম কনসাল্ট করে বেশ খানিকটা সুরাহা হয়েছিল পরবর্তীকালে। বছর দুয়েক বাদে কোনো এক দূরসম্পর্কের জ্যাঠা মশাইয়ের বদান্যতায় মাস্টার্স ইন কমার্স নিখিলেশের এই চাকরিটা জুটেছিল। ধীরে ধীরে চাকরিটায় থিতু হয়ে যান, হিসেব রাখার কাজটাও বেশ ভালো লেগে গিয়েছিলো পরের দিকে। ক্রমশ উন্নতিও হয় স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু সেই থেকে আর বিয়েটা করা হয়ে ওঠে নি। এমন নয় যে জীবনে কোনো নারীর আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি কোনোটাই। নিখিলেশের কোনো না কোনো বেমক্কা আচরণে শেষে গিয়ে ঠিক নাকচ হয়ে যেত সম্বন্ধগুলো । একটা সময়ের পর নিখিলেশের একা থাকাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। তাই কয়েক বছর পর বিয়ের পিঁড়ির প্রতি আর তেমন আকর্ষণ অনুভব করেন নি। সারাদিনে অফিসের কাজ আর পাড়ায় দু চার জনের সাথে আড্ডা দিয়েই সময় কেটে যায় এখন। বাড়ির খুঁটিনাটি কাজের জন্য একজন সারাদিনের লোক আছে, নিখিলেশের থেকে বছর দশেকের ছোট, মেদিনীপুর নিবাসী, বিশ্বস্ত অনুচর, নাম - প্রসাদ। বহু বছর আগে এ বাড়িতে সে ভিক্ষে করতে এসেছিলো। সেই থেকে এখানেই থাকে। রান্নাবান্না, ঘর দোর পরিষ্কার করা ইত্যাদি সমস্ত কাজ সে যত্ন করেই করে। নিখিলেশের রোজনামচা তার মুখস্ত।
আজ সে ভাত বেড়ে দিয়ে নিখিলেশের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'দাদার কি শরীরটা খারাপ লাগছে' ? নিখিলেশ ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে বলেন, হ্যাঁ রে, মাথাটা বেজায় টনটন করছে কেমন যেন, পুরোনো রোগটা আবার ফিরে এলো কিনা কে জানে'।
'তাহলে কি একবার সন্ধের দিকে, মনোময় ডাক্তারের কাছে...........' কথাটা শেষ করতে পারে না প্রসাদ। তার আগেই নিখিলেশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, 'হুমমম, সেরকমই ভেবেছি, দেখি, ফেরার পথে একবার দেখিয়ে আসবো' । 'আচ্ছা', বলে ভিতরে ঢুকে যায় প্রসাদ। নিখিলেশও ভাতের থালা নাড়াচাড়া করে উঠে পড়েন । শরীরে অস্বস্তি হওয়ার ফলে খেতেও ইচ্ছে করে না তেমন। মুখ হাত ধুয়ে বাদামি চামড়ার ব্যাগটা কাঁধে ফেলে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে যান তাড়াতাড়ি । নীলচে রঙের পুরোনো মডেলের একটা মারুতি এইট হান্ড্রেড। চাকরিতে ঢোকার বছর সাত আটেকের মধ্যেই লোনের টাকায় গাড়িটা কিনেছিলেন। বড় শখের গাড়ি তাঁর। পরের দিকে উপায় থাকলেও গাড়িটা আর চেঞ্জ করেন নি। ভালোবেসে ফেলেছিলেন তার সাধের মারুতিটাকে। এখনো সমান যত্ন করেন এবং নিজের সন্তানের মতোই আগলে রাখেন। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অফিসের দিকে বেরিয়ে যান নিখিলেশ। ব্যাথাটা হতেই থাকে ঢিমে তালে।
বিকেলের দিকে নিখিলেশের ডাক পড়ে ম্যানেজারের চেম্বারে।
'আপনার আক্কেলটা বলিহারি মিঃ মুখার্জ্জী, স্টক ব্যালেন্সের সোজা হিসেবগুলো যদি এইভাবে গুলিয়ে ফেলেন তাহলে তো দুদিনেই ব্যবসা লাটে উঠবে। আপনার ভুলের মাশুল নিশ্চয়ই কোম্পানী দেবে না' ? কথাগুলো বলে ভীষণ বিরক্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন ম্যানেজার। অপরাধীর মতো মুখ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন নিখিলেশ। মাথার ব্যাথা তার সাথে অন্যমনস্কতা, দুয়ে মিলেই এমন বিচ্ছিরি অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেছে। তার জন্য নিখিলেশ যারপরনাই লজ্জিত। বার তিনেক ঢোঁক গিলে ক্ষমাও চেয়েছেন, কিন্তু অধস্তন কর্মচারীকে কোনোরকম সুযোগই দিচ্ছেন না দাপুটে কর্তৃপক্ষ । একের পর এক বাঁকা শব্দের শরাঘাতে বিদ্ধ করছেন নিখিলেশকে। নিখিলেশ কাঁচুমাচু মুখ করে বলেন, 'স্যার, আমি এক্সট্রিমলি সরি, আমাকে একটু সময় দিন, আমি পুরোটা রিচেক করে আপডেট করে দেব সমস্ত কিছু। ঘন্টাখানেকের বেশি লাগবে না, কথা দিচ্ছি' ।
- স্ট্রেঞ্জ, ঘন্টাখানেক সময়টা কি আপনি সময় বলে মনে করেন না মিঃ মুখার্জ্জী ! নাকি আপনি ভাবছেন অমন ঘন্টার পর ঘন্টা অপচয় করার মতো যথেষ্ট সময় আছে আমাদের ?
- আজ্ঞে স্যার, আমি ঠিক তা বলতে চাইনি। সামান্য একটা ভুল......আমি এখুনি ঠিক করে দিচ্ছি।
- হাসালেন মিঃ মুখার্জ্জী, কোনটা সামান্য আর কোনটা অসামান্য সে বিচার করার বোধ যদি আপনার থাকতো তাহলে এই ভুলটা কিছুতেই করে উঠতে পারতেন না।
- আসলে স্যার, গত দুদিন ধরে আমার একটা অদ্ভুত মাথাব্যথা........
- এই হচ্ছে মুশকিল জানেন তো ! বুড়ো ঘোড়া তায় আবার বাঙালী ! এই দিয়ে কি আর রেসের বাজি জেতা যায় ? এই বয়েসে এখন আপনার মাথাব্যথা, অম্বল, গ্যাস, বুকজ্বালা, চোঁয়া ঢেকুর এসব হবেই, তাই বলে তো আর কোম্পানী আপনার সুস্থ হওয়ার দিকে হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকতে পারবে না, তাই না ?
মাথা নিচু করে চরম অপমানগুলো হজম করতে থাকেন নিখিলেশ। নিমেষেই কান মাথা লাল হয়ে যায় তাঁর। কাঁচের দরজার ওপারে মাঝেমাঝেই উৎসুক মুখের চাহনি টের পাওয়া যাচ্ছে । বাকি কলিগদের মাঝে সম্মানের আর অবশিষ্ট রইল না কিছু এটা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি । এই অফিসে তিনি একাধারে সিনিয়র এবং সম্মানীয় পদে আসীন। এধরনের বাক্যালাপে অভ্যস্ত নন কোনোভাবেই । আগের ম্যানেজারদের সময়তে এমনটা হয়নি কখনো। বরাবরই তাঁকে সমীহ করে এসেছেন ছোট থেকে বড় সবাই । সেখানে এমন হেনস্থায় তাঁর মাথা শুধু হেঁটই হলো না বরং আত্মাভিমানেও সপাটে চপেটাঘাত পড়লো যেন।
নিখিলেশ ধীরে ধীরে ম্যানেজারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নিজের সিটে গিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকেন খানিক্ষন। চাকরীর পড়ন্ত বেলায় পাওনা বহির্ভূত অসম্মানটা হজম করতে পারেন না কিছুতেই। ভিতরে ভিতরে ঝড় বইতে থাকে। চূড়ান্ত অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে স্টক ব্যালেন্সের ফাইলটা টেনে নিয়ে দ্রুত চোখ বোলাতে থাকেন। আশপাশ থেকে কৌতূহলী চোখের আদানপ্রদান হতে থাকে, কিন্তু সেদিকে খুব একটা আমল না দিয়ে ভুলগুলো সংশোধন করতে থাকেন একমনে। কাজ শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। ম্যানেজারের টেবিলে ফাইলটা রেখে বলেন, 'আমি পুরোটা রেক্টিফাই করে দিয়েছি স্যার, আপনি কি একবার চোখ বুলিয়ে নেবেন প্লিজ' ? ।
'সেটা না করে উপায় আছে নাকি' ? দরকারী কাগজপত্রে সই করতে করতে উদ্ধত কথাগুলো নিখিলেশের মুখের দিকে না তাকিয়েই ছুঁড়ে দেন ম্যানেজার। নিখিলেশ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন, কি বলবেন ভেবে পান না, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন নব্য ম্যানেজারের মুখের দিকে। আগের মতো মুখ নামিয়েই ম্যানেজার বলতে থাকেন, 'আমায় তো অন্যান্য কাজও করতে হয়, আগামী সপ্তাহের অডিট রিপোর্টে এমনিই ডিলে হবে, সুতরাং কালকের আগে দেখে উঠতে পারবো না.......থ্যাংকস টু ইউ ফর মেকিং দিস রিমার্কেবল পারফর্ম্যান্স' । বাঁকা কথাগুলো চাবুকের মতো পড়ে নিখিলেশের সারা শরীরে। কানের মধ্যে দিয়ে ঢুকে সেসব শ্লেষের শব্দ সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে বিষাক্ত জ্বালা ধরিয়ে দেয়। ধীর পায়ে বেরিয়ে আসেন নিখিলেশ। মাথার মধ্যে যেন আগুনের লেলিহান শিখার উপস্থিতি টের পেতে থাকেন । বুঝতে পারেন তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। হাতের কাজগুলো চটপট সেরে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত লিফটের দরজার কাছে চলে আসেন। বোতাম টিপে পার্কিংয়ের সেকেন্ড ফ্লোরে নেমে আসতেই মনে হয় ব্যাথাটা যেন ক্রমশ বিদ্যুৎলতার মতো মাথা থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে । গাড়ির কাছে এসে তাঁর মনে হয় একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলে ভালো হতো, তাহলে বোধহয় এই অস্থিরতা লাঘব হত কিছুটা । এই পার্কিং ফ্লোরের উত্তর দিকটা একটু ফাঁকা ফাঁকাই থাকে । উত্তেজনায় কাঁপা হাতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নেন নিখিলেশ। পাঁচিলের দিকটায় এগোতে যাবেন, হঠাৎ লক্ষ্য করেন ইতিমধ্যেই ম্যানেজার নেমে এসেছেন আর অদ্ভুত ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে । নিখিলেশ একটু হকচকিয়ে যান, পরক্ষনেই সামলে নিয়ে বলেন, 'কিছু বলবেন স্যার' ? ম্যানেজার আঙ্গুল তুলে নিখিলেশের গাড়ির দিকে দেখান । নিখিলেশ কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে, 'আজ্ঞে' ?
- বেসিক সিভিক সেন্সটা কি কিছুতেই আপনার থাকতে নেই মিঃ মুখার্জ্জী ?
একথায় নিখিলেশ খানিকটা বাক্যহারা হয়ে যান, তারপর কোনোরকমে বলেন, 'আ, আমি ঠিক বুঝলাম না স্যার' । ম্যানেজার কোমরে দুহাত দিয়ে বলেন, 'আপনার এই আপদটাকে যেভাবে রেখেছেন, তাতে করে তো আমি আমার গাড়িটা বের করে উঠতে পারছি না' । কথাটা যে তাঁর মারুতি গাড়িটিকে লক্ষ্য করে বলা, এটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না নিখিলেশের। কঠিন গলায় বলেন, 'ওটা আমার গাড়ি স্যার.....আপদ নয়' ।
- বটে ! বেশ তবে ওটাকে নিচের ফ্লোরে রাখবেন এবার থেকে, ওপরে আর নয়।
- কিন্তু কেন ? আমি তো বরাবর এখানেই রাখি।
- অফিসের কিছু গাইডলাইনস তৈরী করেছি মিঃ মুখার্জ্জী, ম্যানেজার বা সমগোত্রীয় এমপ্লয়ীজরা তাঁদের গাড়ি সেকেন্ড ফ্লোরে পার্ক করবেন আর বাকি স্টাফদের নিচের ফ্লোরে পার্ক করতে হবে।
- এটা একটু জবরদস্তি হয়ে গেলো নাকি ?
- কি হলো না হলো সেটার কৈফিয়ৎ নিশ্চই আপনাকে দেব না । বরং যেটা বলা হয়েছে সেটাই করবেন এখন থেকে ।
নিখিলেশের মনে হলো কেউ যেন মাথার ভেতরটায় সজোরে হাতুড়ি দিয়ে পিটছে একনাগাড়ে । কপালের দুপাশে শিরা ফুলে উঠেছে । হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে । দাঁতে দাঁত চেপে পাল্টা জবাব দেন, 'কৈফিয়ৎ আপনি নাই দিতে পারেন, কিন্তু অন্যায্য কারণে আপনারও হুকুম মানতে ঠিক বাধ্য নই আমি'। এহেন অপ্রত্যাশিত জবাবে ম্যানেজার ক্ষণিক স্তব্ধ হয়ে যান এবং পরক্ষনেই ভয়ানক চিৎকার করে বলেন, 'হাউ ডেয়ার ইউ টক্ টু মি লাইক দিস !! আপনি জানেন আপনি কার সাথে কথা বলছেন' ?
নিখিলেশের চোখ মুখ দাবানলের মতো জ্বলতে থাকে । সারা শরীর দারুণ উত্তাপে ঝলসে যেতে থাকে যেন। ক্রুদ্ধ চাহনি দিয়ে বলেন, 'জানি..... আমি একজন অভদ্র, উন্মাদ, এরোগেন্ট মূর্খের সাথে কথা বলছি, যে মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না, দুর্ব্যবহার ও হেনস্থার চাবুকে কর্মচারীদের নাজেহাল করে রাখে'....... ।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠেন ম্যানেজার, 'শাট ইওর ফাকিং মাউথ মুখার্জ্জীইই !! আই উইল মেক ইয়োর লাইফ হেল ইউ ব্লাডি সোয়াইন........' । কথাটা পুরো শেষ করতে পারেন না। তার আগেই পাঁচিলের ধার ঘেঁষে পরে থাকা একটা কংক্রিটের চাঙড় তুলে নিয়ে সজোরে ম্যানেজারের মাথায় বসিয়ে দেন নিখিলেশ। মিনিট খানেকের কম্পন আর মৃদু গোঙানির আওয়াজ। কিছুক্ষনের মধ্যেই পার্কিং ফ্লোরে নিথর হয়ে যায় ম্যানেজারের শরীর............
পরদিন সকালে ডাইনিং টেবিলে নিয়মমতো চায়ের কাপের সাথে সকালের কাগজটা বাড়িয়ে দেয় প্রসাদ। নিখিলেশ চায়ের কাপে হালকা চুমুক দেন। প্রসাদ জিজ্ঞেস করে, 'ওষুধটা এনে দেব দাদা' ? নিখিলেশ বলেন, 'থাক, দরকার নেই, কাল থেকে আর ব্যাথাটা হচ্ছে না' । 'তুমি কি এখনি অফিস বেরোবে' ? প্রসাদ আবার জিজ্ঞেস করে। নিখিলেশ নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেন, 'নাহ, আজ আর বেরোব না কোথাও'। প্রসাদ আশ্বস্ত হয়ে বলে, 'সেই ভাল, আজ বরং একটু বিশ্রাম নাও, গতকাল রাত থেকে তো দুচোখের পাতা এক করতে পারনি, আমায় ফাঁকি দিতে পারবে না, আমি জানি'। মৃদু হাসেন নিখিলেশ, বলেন, 'সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও পার্কিংয়ের সিসিটিভিটাকে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারিনি জানিস, ধরা ঠিক পরেই যাব। বছর ত্রিশ আগে পার পেয়ে গেছি.......তবে আজ আর কোনো উপায় নেই'। প্রসাদ অবাক হয়ে বলে, 'মানে' ? কোনো উত্তর না দিয়ে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে কাগজটা চোখের সামনে ধরেন নিখিলেশ। দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় হেডলাইনটা গোটা গোটা হরফে জ্বলজ্বল করছে -
"কলকাতার বুকে স্টোনম্যানের পুনরাবির্ভাব"।