Tuesday, February 11, 2025

বাড়ির পাশেই কলকাতা # ১ | নিপন্যান মিয়োহজি

 সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতো  - "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া - ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া" ..........  ঘরের আশেপাশেই এমন অনেক অচেনা শিশিরবিন্দু আছে যাদের খোঁজ থাকে না আমাদের কাছে। হঠাৎ করে দেখতে পেলে বিস্ময়ে মন ভরে ওঠে। 

ঢাকুরিয়া ব্রিজের ঢিল ছোঁড়ার দূরত্ত্বের মধ্যেই এমন একটা শান্ত স্নিগ্ধ বৌদ্ধ মন্দির আছে, না গেলে জানতেই পারতাম না। গোলপার্ক থেকে এলে, ঢাকুরিয়া ব্রিজে না উঠে, বাঁদিকের রাস্তা ধরে এ.এম.আর.আই হাসপাতালের গা ঘেঁষে সোজা চলে যেতে হবে। খানিকটা গিয়ে ডানদিক ঘুরলেই বাঁ হাতে পড়বে শ্বেতরঙা ছিমছাম 'নিপন্যান মিয়োহজি' বৌদ্ধ মন্দির। আর লেকের দিক থেকে এলে পূর্ব দিকে পড়বে।  

মন্দিরের ভক্তরা বলেন ভারতবর্ষে স্থাপিত দ্বিতীয় জাপানি বৌদ্ধ মন্দিরটি এই কলকাতাতেই তৈরী হয়। স্থাপন করেন বৌদ্ধ ধর্মের পদ্মসূত্রের জাপানি অনুগামী নিচিদাৎসু ফুজি। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে এলে চোখে পড়বে বৌদ্ধ - লিপি "না - মু - মিয়ো - হো - রেঙ - গে - কিয়ো" যার বাংলা তর্জমা করলে কতকটা এমন দাঁড়ায়  - "আমি তোমার পদ্মসূত্রের বিধানে আশ্রয় নিলাম" । 

প্রবেশদ্বারের মধ্যে দিয়ে ঢুকলে ডানদিকে মন্দিরটি পড়বে আর বাঁদিকে পড়বে একটুকরো সুজজ্জিত বাগান, যেখানে সন্ধেবেলার হলদেটে নিভু আলোর মায়ায় এমনিই খানিকক্ষণ সময় কাটাতে ইচ্ছে করবে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠে যখন মূল মন্দিরে প্রবেশ করবেন তখন এক লহমায় আপনার পিছনের কলকাতা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, মনে হবে কোনো এক দূর পাহাড়ের বৌদ্ধ মঠে এসে দাঁড়িয়েছেন। 

ভিতরে একেবারে মাঝবরাবর উপবিষ্ট বুদ্ধদেবের একটি মার্বেল মূর্তি দেখতে পাবেন যাঁর সামনের বেদীটি মখমলি কাপড় আর পিতলের প্রদীপ দিয়ে সজ্জিত। ছাদ থেকে ঝুলছে সুদৃশ্য ল্যাম্প শেড, বাহারি কাপড়ের সজ্জা আর দেওয়ালের চারপাশে সুন্দর করে আঁকা আছে জাপানি ক্যালিগ্রাফি। তার ঠিক পিছনে প্রতিষ্ঠাতা নিচিদাৎসু ফুজির একটি ছবি রাখা রয়েছে। 

আমরা গিয়েছিলাম পাঁচটা নাগাদ। সোয়া পাঁচটা নাগাদ সন্ধ্যা আরতি শুরু হয়। আরতি করেন উত্তর পূর্ব ভারত থেকে আসা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। সুরেলা মিহি ঘন্টাধ্বনি, গুরুগম্ভীর ব্যারেল ড্রামের সঙ্গত আর ছন্দময় বৌদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণ সবটা মিলিয়ে এমন মনভালো করা পরিবেশ তৈরী হয়েছিল যে আমরা শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে সমস্তটা ভরে নিচ্ছিলাম নিজেদের ভিতর। খাস দক্ষিণ কলকাতার বুকের ওপর এমন শান্তির ঠিকানা, বিস্ময় জাগায় বৈকি। কিভাবে সময় কেটে গিয়েছিল জানিনা......আরতির সময় পেরিয়ে যখন বাইরে বেরোলাম তখন লেকের জলে মাঘের সন্ধ্যার ছায়া। ধীর লয়ে স্বস্তির হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল আমাদের ছুঁয়ে। মন ভালো হয়ে গিয়েছিল সবার......স্থির করলাম এবার থেকে সময় পেলেই কলকাতা খুঁজতে বেরোব, কলকাতার মধ্যেই.........

আপনারাও যদি কলকাতা খুঁজতে চান তাহলে চোখ রাখুন আমার "মলাটের" পাতায়.......

পরের গন্তব্য আসবে......




Friday, April 19, 2024

মন দেউলিয়া




ছোট পরিসরে পরিচিত স্বরে
আদরে আখরে নাম
কালো দীঘি চোখ, সে আমার হোক
বৃষ্টি হোক অনন্ত অবিরাম। 

জোয়ারের ঢেউ বলেনি তো কেউ
নাবিকের মতো কথা
রুদ্ধশ্বাস, কঠোর প্রয়াস
মনদেউলিয়া ব্যাথা।

আধখোলা দোর রাতজাগা ভোর
মোহনা পেরোনো নদী
নোঙর ফেলা খেলনার ভেলা
আমার হত যদি।

শত হাতছানি দেয় অভিমানী
মেঘবালিকার খাতা
মরুঝড় জল, স্রোতে বিহ্বল
মনদেউলিয়া ব্যাথা।

Friday, December 29, 2023

মন-মেহুলী


একটুকরো মেঘই বটে। সার্থক নামকরণ এই খামারবাড়িটার। একটা ছায়াঘেরা গ্রাম, আঁকাবাঁকা মাটির পথ, চোখ জুড়ানো ধানের ক্ষেত আর একটা টলটলে সায়র, এই সবটা মিলিয়ে 'মেহুলী'। বীরভূম জেলায় ইলামবাজার আর বোলপুরের মাঝামাঝি একটা প্রত্যন্ত গ্রাম কামারপাড়া। এই কামারপাড়ার শেষ প্রান্তে মেহুলী অপেক্ষায় থাকে পর্যটকদের। 

সপ্তাহান্তের ভ্রমণের জন্য মেহুলী একেবারে নিখুঁত স্পট। বর্ধমান - গুসকরা - বোলপুর ছুঁয়ে আমরা যখন কামারপাড়া পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকেল। ছোট্ট লোহার গেট খুলে যখন সামনের বাগানটায় পা রাখতেই মন জুড়িয়ে গেলো এক লহমায়। মাথার ওপর নানান রকমের গাছ, পাখিদের ঘরে ফেরার গান আর "গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথের" মনকেমন করা গন্ধ, মনে হল এই জায়গাটার অপেক্ষাতেই ছিলুম যেন কতকাল। মাটির ওপরে সারি দিয়ে সাজানো স্ল্যাব পেরিয়ে যখন বারান্দায় উপস্থিত হলাম তখন খিদে পেয়েছে সাংঘাতিক। বারান্দাতেই পরিপাটি করে খাবারের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ভাত, ডাল, আলুভাজা আর মুরগির ঝোল - অমৃতও বোধহয় এতো সুস্বাদু হয় না, তার ছাপ আমাদের চোখে মুখে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। 

লাগেজ রেখে একটা অটো বুক করে আমরা সোজা রওনা দিয়েছিলুম সোনাঝুড়ির হাটে। সেখান থেকে খানিক কেনাকাটা করে যখন ফিরলাম ততক্ষনে সূর্য অস্ত গেছে। নির্মেঘ আকাশটা তখন কালো চাদরে মুখ ঢেকেছে, অসংখ্য নক্ষত্রের আলো আর ঝিঁঝি পোকার শব্দে চারপাশটা ভেসে যাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে রাতের বাগানটাতেই পায়চারি করলাম খানিক, ঠান্ডা খানিক জোরালো হওয়ায় ঘরের ভেতর ঢুকেছিলাম। 

বেশ খানিক্ষন আড্ডা মারার পর রাতের খাবারের সময় হল। প্রায়ান্ধকার বারান্দায় আর লণ্ঠনের টিমটিমে আলোয় যে পরিবেশটা তৈরী হয়েছিল তাতে করে তাতে করে যেকোনো বাংলা ছবির পরিচালককে দৃশ্য পরিকল্পনায় খুব বেশি খাটতে হবে না। আমাদের মনে হয়েছিল ঠান্ডাটা না থাকলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় এখানে। 

 

পরদিন ঘুম ভাঙলো টিয়াপাখির আওয়াজে। আগের থেকে খেজুরের রসের কথা বলা ছিল। ভোর পাঁচটায় যখন কাচের গ্লাসে চুমুক দিলাম তখন মনে হল স্বর্গ শুধু কাশ্মীরে নয় এই পশ্চিমবঙ্গেও আছে। প্রায় দু গ্লাস খাওয়ার পর উত্তর দিকের সায়রটার দিকে এগিয়ে গেলাম। জলের ঠিক মাঝামাঝি খানিক কুয়াশা আর চারপাশটা আলো হয়ে আছে। পুরো সায়রটা একচক্কর দিয়ে আসতে আমাদের প্রায় আধঘন্টা সময় লেগেছিল। 

দিনের সময়টা শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায় কাটিয়ে সন্ধ্যের দিকে ফিরে এলাম আবার মেহুলীর স্নিগ্ধতায়। এমন মনকাড়া, পরিপাটি, যত্নের ছাপ আর কোনো হোমস্টেতে পাবেন কিনা জানা নেই। আমরা দুরাত্রি - তিনদিন কাটিয়ে অপার ভালোলাগা নিয়ে ফিরে এসেছিলাম কলকাতায়। 

ধন্যবাদ প্রাপ্য মেহুলীর শ্বেতাদির , যাঁর জন্য এই ট্যুরটা সম্ভব হল, আর অবশ্যই আমাদের বন্ধু সৌম্য আর সুস্মিতার যারা এই ঠিকানার খোঁজ দিয়েছিল। 


এই জায়গায় যেতে হলে আপনি গাড়ি নিয়ে বর্ধমান - গুসকরা - বোলপুর ছুঁয়ে আসতে পারেন আবার ইলামবাজার হয়েও ঢুকতে পারেন। ট্রেনে আসতে গেলে আপনাকে বোলপুর স্টেশন নামতে হবে। স্টেশন থেকে অটো বা টোটো করে নিতে পারেন কামারপাড়া অবধি। বাকিটা মিনিটখানেক। কামারপাড়াতে থেকে আপনি অনায়েসেই বেড়ানোর পরিকল্পনা করতে পারেন - বোলপুর-শান্তিনিকেতন, খোয়াই, ইলামবাজারের জঙ্গল ইত্যাদি। 

হলপ করে বলতে পারি, ছোট্ট উইকেন্ড ট্রিপের জন্য মেহুলীর বিকল্প খুব কমই আছে, বিশেষ করে শীতকালে।  


Saturday, November 11, 2023

হৃদয়ের নাম তিনচুলে-পাবং-সিটং

ছবি : চারখোলের পাহাড় থেকে 

কলকাতার ক্যাকোফোনি কাটিয়ে এক হপ্তা যেখান থেকে ঘুরে এলাম সেখান থেকে ফিরতে মন চায়নি একটুও। পাহাড়ের খাঁজে আটকে থাকা ছবির মতো কতগুলো গ্রাম, যেখানে গেলেই মনের আনাচে কানাচে জমে থাকা মেঘগুলো সরে গিয়ে ঝকঝকে আকাশ বেরিয়ে পড়ে। ধমনীর মধ্যে দিয়ে তিরতির করে বয়ে যায় তিস্তা আর নাকে আসে ঝাউ আর পাইনের ঘ্রাণ।  

তিনচুলে

প্রায় ৬ হাজার ফিট উঁচুতে আর দার্জিলিয়ের কাছেই যে গ্রামটা তার নামের কারণটা ভারী মজার।তিনচুলে কথাটা এসেছে  "তিন" আর চুলে হল "চুলা" বা "উনুন" থেকে । তিনটি পাহাড় দিয়ে ঘেরা বলে কতকটা উনুনের মত দেখতে লাগে জায়গাটা, তাই এই গ্রামের নাম তিনচুলে। আমরা ছিলাম রুমি হোমস্টেতে যার বারান্দা থেকে পূর্ব দিকের রোদটা ঝপাং করে এসে মুখে চোখে খানিক উষ্ণতা মাখিয়ে  দিয়ে যেত। চোখের সামনে পাহাড়ের গা ছুঁয়ে নামতে থাকা কুয়াশার শিফন ক্রমশ মিশত আঁকাবাঁকা তিস্তার পাড়ে। আর ঠিক পিছন দিকটা, যেখানে পাহাড় ঘেড়া ঝাউয়ের জঙ্গল সেখান থেকে একটা ঝোড়া নেমে আসে যার জলের মিঠে আওয়াজটুকু ছাড়া আর কোনো শব্দই পাওয়া যাওয়া যায় না কোথাও। হ্যাঁ সেটা সকালবেলাতেই..... এতটাই নিস্তব্ধ তিনচুলে। 

ছবি : তিনচুলের হোমস্টের বারান্দা থেকে 

তিনচুলের বারান্দায় সকালের রোদটা পুইয়ে আমরা চলে গিয়েছিলাম লেপচাজগৎ। ঘুম আর সুখিয়াপোখরির রাস্তা দিয়ে এলে খানিকটা সুবিধে হয়। প্রায় ৭ হাজার ফিট উচ্চতায় লেপচাজগৎ -এর জঙ্গল, যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল মেঘ ফুঁড়ে ওঠা দিগন্ত বিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার অহংকার। এখান থেকে আধঘন্টার রাস্তা - লামাহাট্টা। সেখানে যতদূর চোখ যাবে দেখতে পাওয়া যাবে তীক্ষ্ণ বর্শার মতো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাইন আর ঝাউ এর জঙ্গল। মনে হবে অতন্দ্র প্রহরীর মতো এরা যেন আগলে রেখেছে জায়গাটা।

পাবং 

দু রাত কাটিয়ে আমরা রওনা দিয়েছিলাম পাবং এর পথে। তিনচুলে থেকে প্রায় ঘন্টা দুয়েকের পথ। কালিম্পঙ এর পাহাড় ঘেরা হাতের তালুর মাপের একটা গ্রাম - পাবং। তবে সে গ্রাম আপনাকে জড়িয়ে ফেলবে আষ্টেপৃষ্ঠে, তার সমস্ত শান্তি, নিষ্পাপ সরলতা নিয়ে, আর চোখের সামনে দুহাত উপুড় করে মেলে ধরবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার অলস অবকাশ। 

ছবি : পাবং-এর হোমস্টে  থেকে  

এখান থেকে কয়েক মিনিটের পথ চারখোলে, যার নামের অর্থ - "চারদিক খোলা"। পাহাড়ের একেবারে ওপর থেকে দেখতে পাওয়া যাবে কালিম্পঙের গোটা উপত্যকাটাই। এখানে হেলায় পড়ে থাকা পাহাড়ি ফুলের রং-এ মন চাঙ্গা হয়ে যায় অচিরেই। 

সন্ধ্যে নামলে পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মতো জ্বলে উঠত কালিম্পঙ। হোমস্টের সামনের উঠোনটায় ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আর আমরা দু চোখ ভোরে দেখে নিতাম। এখান থেকে লাভা, লোলেগাঁও বা রিশপ যাওয়া যেতে পারে অনায়াসেই।

সিটং 

পাবং-এও দু রাত কাটিয়ে আমরা রওনা দিয়েছিলাম সিটং এর উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে মংপু ঘুরে গিয়েছিলাম। ভারী সুন্দর জায়গা। রবীন্দ্র ভবনে খানিক সময় কাটিয়ে তারপর সিটং পৌঁছেছিলাম। তবে এখানে একটা নয়, কয়েকটা গ্রাম নিয়ে সিটং জায়গাটা। পাবং থেকে বেশ খানিকটা নিচুতে, কার্শিয়াং এলাকায় নয়নাভিরাম সিটংএর উপত্যকা ভীষণ মন টানে। এখানে দু হাত অন্তর হোমস্টে, সুতরাং বুকিংয়ের বিন্দুমাত্র সমস্যা নেই। কমলালেবুর বাগানের জন্য সিটং বিখ্যাত। সারি দেওয়া কমলালেবুর গাছ দেখে তাক লেগে গিয়েছিলো আমাদের। শয়ে শয়ে কমলালেবু ঝুলছে একেবারে হাতের নাগালের মধ্যেই। পেড়ে খেয়েও ছিলাম দু একটা, পাকার সময় হয়নি বলে বেশ টক ছিল। 

ছবি : সিটং এর পথে 

এক রাত কাটিয়ে, সিটংএর উপত্যকা ছেড়ে যখন নেমে আসছিলাম, তখন রাস্তার দুপাশে সারি দেওয়া ঝাউ, শাল, সেগুন, সিঙ্কোনার জঙ্গলে দু চোখ জুড়িয়ে গেছিল। রং বেরঙের ফুলের গাছ, অজস্র ফার্ন ও কত নাম না জানা গাছ নুয়ে পড়েছে রাস্তার ওপর। সেসব পেছনে ফেলে সেবকের রাস্তা ধরতেই অজান্তেই মনের কোণে মেঘ জমছিল। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে যখন পিছন ফিরে তাকালাম, দূরের পাহাড়ে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। 

ট্রেনের হুইসেল কানে কানে বলে গেল - "সুযোগ হলে আবার কখনো......."

পাহাড় এড়ানো সাংঘাতিক কঠিন যে ......   


Saturday, May 13, 2023

পাকোদা - ইতিহাসের নাম

পাকোদা - এমন অদ্ভুত নাম কেন হল সেটা ওনারও জানা নেই। তবে পাকোদা একটা ইতিহাসের নাম, কয়েকটা যুগ আর একটা "ছোট্ট কথার দাম" হল পাকোদা। সেটা কোন "কথা" সে বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে একটা চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে নি। 

১৯৬৭ সালে পাকোদা প্রায় এক বস্ত্রে, বলা ভালো হাফ প্যান্টে চলে আসেন কলকাতায় কাজের সন্ধানে, এক আত্মীয়র হাত ধরে, যিনি তদানীন্তন উত্তর কলকাতার এক বিখ্যাত বাড়িতে রান্নার কাজ সামলাতেন। বেথুন কলেজের পিছনে ১৩৩ নম্বর রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের বাড়িটি বিখ্যাত, তার কারণ আজ থেকে প্রায় দুশ বছর আগে প্রসিদ্ধ উর্দু কবি মির্জা গালিব নাকি কলকাতায় এই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।

বিষয়টা তর্কাতীত হলেও মির্জা গালিবের ভাড়া বাড়ি হিসেবে গুগল খুঁজলে এই প্রাসাদোপম বাড়ির ছবিই দেখাবে। 

গত রবিবার ইতিহাসের শায়রী জড়ানো এই বাড়িতে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ঘটনাক্রমে এই বাড়িটি আমার শ্বশুর মশাইয়ের পিসীমার বাসস্থান। মজার ব্যাপার হল ওই বাড়ির অধিকাংশ ওয়ারিশ হয় উকিল নয় এটর্নি। আমার শ্বশুর মশাইয়ের পিসেমশাই শ্রী রমেন্দ্রনাথ ধর তাঁর সময়কার বেশ নামকরা এটর্নি ছিলেন। অন্দরমহলের খবর, এই অট্টালিকার পুরোটাই পরবর্তী কালে উনি কিনে নেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পাকোদার সাথে এসবের কি সম্পর্ক ? সমস্ত কিছু ছাপিয়ে এই লেখাটা শুধুমাত্র সেই বিষয় নিয়েই.......

না, কোনো রকম রক্তের সম্পর্ক নেই ঠিকই তবে বছরের পর বছর নিষ্ঠা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে কখন যে পাকোদার আত্মার সাথে যোগাযোগ ঘটে গেছে এই বাড়ির, তা এক বিরাট উপন্যাস। সে কথা জানতে চাইলে, পাকোদা সহাস্যে এড়িয়ে যায়। তবু আমি চাপাচাপি করি, জানতে চাই পুরোনো রংচটা ইতিহাসের হালখাতা, কারণ আমি যে আনকোরা গল্পের গন্ধ পেয়েছি ততক্ষণে। 

জোর করে প্রশ্ন করি..... 

- আচ্ছা আপনি যখন এই বাড়িতে আসেন তখন আপনার বয়স কত?

পাকোদা খানিক লজ্জায়, খানিক আতান্তরে পরে উত্তর দিতে থাকেন।

- ওই দশ বারো হবে...

- আগে কোথায় থাকতেন?

- উড়িষ্যা, বালেশ্বর....

- সেখান থেকে চলে এলেন কেন ?

- কাজের দরকার ছিল যে.....

- এত কম বয়সে ?

- হ্যাঁ, বাবা মা মারা গিয়েছিল, তাই.....

- তা এখানেই থেকে গেলেন ? ....আজীবন ?

- (মাথা নেড়ে)...... হ্যাঁ..... 

- অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করল না ?

- না, এ বাড়ির বাবু চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, "আমি না থাকলে বাকিদের দেখিস"। আমিও রয়ে গেলাম.......

- রয়ে গেলেন...... মানে ?

- কথা দিয়েছি, যাওয়া হল না.....

কথাটা হজম করতে সময় লাগল। বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায় আমি বাকরুদ্ধ রইলাম কিছু মূহুর্ত। যাঁরা জানতেন না তাঁরাও হতবাক তাকিয়ে রইলেন পাকোদার দিকে। এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমনটা সম্ভব !!!.......... কিংবা হয়ত সম্ভব, যাঁরা জানেন মুখের কথার মূল্য আছে, বোধহয় তাঁদের পক্ষেই সম্ভব। 

ঘোর কাটতে সময় লাগল খানিক। কোনো প্রশ্ন জোগালো না মুখে, ইচ্ছেও করল না। হয়ত পাকোদার অন্য কোথাও যাওয়ার সঙ্গতি ছিল না, বা হয়ত সত্যিই উনি কোথাও যেতে চান নি। বর্তমান সময়ে সেসব কথা অবান্তর।

তবে উত্তর কলকাতার বুকে বহু বছর আগে দেওয়া শুধুমাত্র মুখের কথা একনিষ্ঠ ভাবে মেনে চলেছেন পাকোদা..... একটানা.....একভাবে....... এইটুকুনটাই সম্ভ্রম জাগানোর জন্য যথেষ্ট। 

পাকোদা আপানি সুস্থ থাকুন, আর আরও একবার আমার শ্রদ্ধা জানবেন।

আর বাড়ির সমস্ত মানুষদের আমার প্রণাম যাঁরা পাকোদার দেখাশোনা করে চেলেছেন নিরন্তর। 



Friday, April 28, 2023

কালবৈশাখে তুমি

টুকরো কথার মেঘ জমেছে মনে 
ডুবছে আকাশ জানলা ভাঙার কাঁচে, 
সোহাগ চিঠি যত্নে দেরাজ কোণে 
বুকের মধ্যে কালবৈশাখ বাঁচে। 

তেমন করে কোথাও তুমি নেই
যেমন করে থাকতে তুমি কাছে,
ঘুলঘুলিতে চড়াই এলো যেই
নিষেধ মানার নিয়ম দিলে মুছে। 

তোমার নামে এখন বিকেল গড়ায় 
কুলফি বরফ ডাক দিয়ে যায় গলি
তেঁতুল আচার গন্ধ বয়ে বেড়ায়
শেষের তোমার গল্প কাকে বলি ? 

দেরি হলেও সময় হয়ে এসো 
ঘড়ির কাঁটায় আলগা কিছুক্ষন,
আমার প্রাপ্যটুকুই ভালোবেসো
কালবৈশাখে তোমায় প্রয়োজন।   









Saturday, March 18, 2023

অতীত

পুরোনো দিন যত্নে রাখা দায়
পুরোনো জরা আসবাবের মতো,
কি করে তাদের সাজাব বিদায়
আমি জানি আমিও নই অক্ষত। 

জোনাকির আলো জ্বেলেছিল যারা
নাবিকের পাল পুড়েছিল হাওয়ায়,
তাদের এখন সঙ্গী ধ্রুবতারা
নিঃশব্দে আকাশ ছুঁতে চায়। 

সহজ অতই ভেসে যাওয়া নাকি 
মুখ তুলে শত অভিমানও শুনো,
আমার পাথর হয়ে থাকাটাই সাবেকী
কিছু কবিতা জমে আছে এখনো। 

ছন্দে ফেরা সময়ের হাতে বাঁধা
কত গ্রীষ্ম কত পার হয়ে যাবে শীত,
বাক্সের ভাঁজে পুরোনো নকশিকাঁথা
শান্তিতে থাক তোমার আমার অতীত। 



#bengalipoem #bengaliquotes #bengalipoetry #banglakobita #kolkata #bengali #banglaquotes #bengaliquote #bong #kolkatagram #bangladeshi #bengaliwriters #banglagram #westbengal #banglapoetry #poem

Thursday, April 8, 2021

ভাষার জুলুম

সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক উৎসবে প্রত্যাশা মতোই মানুষের প্রাতঃরাশের থালায় এখন রাজনীতির নানান পদ। একদিকে পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে গড়ে ওঠা বড়, ছোট, মাঝারি সমস্ত দল অন্যদিকে ধর্মীয় রাজনীতির আবহে বেড়ে ওঠা এক সর্বভারতীয় পার্টি। 

রাজনীতির গনগনে আঁচ যখন বাংলার অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ছে ঠিক সেই সময় কোনো এক অজ্ঞাতকারণে একটি সরকারি নির্দেশনামা নেমে এল এমন এক জায়গায় যা বৈজ্ঞানিক গবেষণার শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ২৪শে মার্চ ২০২১ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর দা কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠানে প্রায় সমস্ত পর্যায়ে হিন্দি ভাষাতেই লেখালিখি করতে হবে। ৫৫% চিঠিপত্র হিন্দিতে লিখতে হবে (সে মানুষ হিন্দি জানুন বা নাই জানুন, কিচ্ছু এসে যায় না) এবং হিন্দিতে লেখা চিঠির জবাব দিতে হবে হিন্দিতেই। ফাইলে প্রথম নাম লিখতে হবে হিন্দিতে, পরে ইংরেজিতে। সার্ভিস বুকও যথাসম্ভব হিন্দিতে লিখতে হবে, প্রয়োজনে ফাইলে স্বাক্ষরও করতে হবে হিন্দিতে। এখানেই শেষ নয়, এই হিন্দি ভাষার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তার নিয়মিত নজরদারি করা হবে এবং এই অত্যাশ্চর্য নিয়মের অন্যথা হলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে, এমনটাই বলা আছে। 

আতঙ্কের ব্যাপার হল এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, ছাত্র, গবেষক ও অন্যান্য শিক্ষাকর্মীদের প্রায় ৯০ শতাংশই বাঙালি যাদের মধ্যে এহেন নির্দেশিকায় যুগপৎ বিস্ময় ও বিতর্ক ছড়িয়েছে। এই সাংঘাতিক কর্মকাণ্ডের অর্থ হল বাঙালি যদি না শোনে তাহলে বাঙালির কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে জোর করে  হিন্দিতে লেখাতে হবে এবং তেমন প্রয়োজন হলে পরবর্তী সময়ে জোর করে বলাতেও হবে।  

স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যিক ও শিক্ষিত মহলে এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ উঠে এসেছে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই ন্যক্কারজনক সিদ্ধান্তকে 'ভাষা-সন্ত্রাস' নামে আখ্যা দিয়েছেন এবং বিখ্যাত বাঙালি অধ্যাপক সুগত বসু এর তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছেন এমন নির্দেশ বিজ্ঞান চর্চার অন্তরায় এবং বাংলার জন্য মর্যাদাহানিকর। 

বাংলা ও বাঙালির সম্মানে এমন খড়্গাঘাত অবশ্য এখানেই থেমে থাকছ না। গত ১৩ই ডিসেম্বর ২০২০-তে আনন্দাবাজার পত্রিকায় আরেকটি প্রতিবেদনে বেরিয়েছিল যে সাংসদ সুব্রহ্মন্য়ম স্বামী ভারতের জাতীয় সংগীত জনগণমন-র পরিবর্তন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এবং সে চিঠির দ্রুত সাড়াও পেয়েছিলেন। এক্ষেত্রে আন্দাজ করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না যে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে আপাতত এই প্রস্তাবটি স্থগিত রাখা আছে, তবে ভোট মিটলেই সে প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। 

এসবের পরে খুব সঙ্গত কয়েকটা প্রশ্ন উঠছে - আমরা কি অজান্তেই বড্ড বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছি কতিপয় নেতা নেত্রীদের যার ফল ভুগতে হচ্ছে আমাদেরই ? নাকি বাংলার মানুষকে নির্বোধ ও দুর্বল ভাবছেন কিছু শ্রেণীর মানুষ ? তাই যদি হয় তাহলে যারা বাংলা ভাষাটাকে খাটো করে, জোর করে অন্য ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইছেন তাদের জেনে রাখা ভালো যে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ বা বিপ্লব, এসবের কোনো কিছু গড়ে উঠতে সময় লাগে না এই পুণ্য বঙ্গভূমিতে.... ইতিহাস জানে সে কথা.....

Saturday, October 17, 2020

দূরত্ত্বের মাঝামাঝি

পরবর্তী স্টেশন, কালীঘাট। প্ল্যাটফর্ম ডানদিকে। 

আগলা স্টেশন, কালীঘাট। প্ল্যাটফর্ম ডাহিনে তরফ। 

দ্য নেক্সট স্টেশন ইজ কালীঘাট। প্ল্যাটফর্ম ইজ অন দ্য রাইট সাইড। 

পরপর তিনটে ভাষায় মধুমন্তী মৈত্রের দৃপ্ত কণ্ঠের ঘোষণা বেজে ওঠে মেট্রোর প্রথম কামরা থেকে শেষ কামরা অবধি। সুকন্যার চোখ চলে যায় উল্টোদিকের দেওয়ালে ডিজিটাল স্ক্রিনের ওপর। পরবর্তী স্টেশনের নাম হালকা হলদেটে আলোর বলয়ে ফুটে উঠেছে। দু চারজন যাত্রী ধীরে ধীরে সিট্ ছেড়ে উঠে পড়ে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। এখন আর সেই পুরোনো দমবন্ধ করা ভিড়টা নেই। মৌমাছির চাকের মতো একে ওপরের গায়ে সেঁটে থাকার বিড়ম্বনাও ইদানীং উধাও । উপরন্তু মেট্রো রেলের নানান নিয়ম কানুনের ঘেরাটোপে অধিকাংশ কামরাগুলো একপ্রকার ফাঁকা বললেই চলে। যেসমস্ত স্টেশনে মাছি গলবার জো ছিল না সেসব স্টেশনে দূরে দাঁড়ানো মানুষের কথাও টানেলের দেওয়ালে ঠিকরে লেগে কানে ভেসে আসে। 

সুকন্যা সিট্ পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। সামাজিক দূরত্বের নিয়মে একটা সিট্ ছেড়ে বসতে হয় এখন। স্বাভাবিকভাবেই টালিগঞ্জ বা তার আগের স্টেশন থেকেই সিটগুলো ভর্তি হয়ে আসে। সুকন্যা রবীন্দ্র সরোবর থেকে ওঠে বরাবর, চারু মার্কেটের কাছাকছি থাকার ফলে সুবিধে হয়। তার গন্তব্য মহাত্মা গান্ধী রোড স্টেশন। দেরি আছে এখন। সোয়া দশটার মধ্যে ইউনিভার্সিটি ঢুকতে হবে। সাড়ে দশটায় ফার্স্ট ক্লাস। 

কম্প্যারেটিভ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেচারের ছাত্রী সুকন্যা, ফাইনাল ইয়ার মাস্টার্স । ভারতীয় ভাষার প্রতি অগাধ অনুরাগ। সেখানে তাকে আরও বেশি আকর্ষণ করে থিয়েটার এন্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজ। এই ভালোবাসাটা সুকন্যা শিরায় উপশিরায় বয়ে বেড়ায়। এমন বিরল বিষয়ের প্রতি প্রেম খুব একটা আকস্মিক নয়। তার কারণ সুকন্যার মা একই বিষয়ের ছাত্রী ছিলেন। পাশাপাশি একটা নামী নাট্যগোষ্ঠীর হয়ে কয়েক বছর মঞ্চে অভিনয় করেছেন। খুব ছোট বয়েসে সুকন্যার পিতৃবিয়োগের পর  সমস্ত তালিম মায়ের কাছ থেকেই পেয়ে এসেছে সে। সুতরাং এই আবহে বড় হয়ে ওঠাটা একরকম অনুঘটকের কাজ করেছে সুকন্যার বিষয় নির্বাচনে। 

পরবর্তী স্টেশন যতীন দাস পার্ক, প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে.......

অভ্যাসবশত সুকন্যা দেওয়ালে ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে তাকায়। সেখান থেকে চোখ নামাতে গিয়ে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যায় একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে। মধ্য পঞ্চাশের আশেপাশে বয়স হবে। ছ ফুটের কাছাকাছি হাইট, মাঝারি গড়ন। মাথায় কাঁচাপাকা ঘন চুল। চোখে রিমলেস চশমা। সুপুরুষ বললে অন্যায় কিছু বলা হবে না। ভদ্রলোক অকলুষ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। সামান্য অপ্রস্তুত হয় সুকন্যা। পথেঘাটে পুরুষ মানুষদের বিভিন্ন চাহনিতে অভ্যাস হয়ে গেছে তার। আধুনিক বেশভূষায় সজ্জিতা সুকন্যার সুশ্রী চেহারায় লাবণ্যের চিহ্ন ভীষণ রকম চোখ টানে। সুকন্যা খেয়াল করে ভদ্রলোক যেন বেশ খানিকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। 

এই সামাজিক দূরত্বের সময়ে এমনটা বড় বেমানান লাগে। মুখেচোখে অস্বস্তি প্রকাশ পেলেও সুকন্যা কোনো কথা বলে না, সামান্য বাঁদিকে সরে দাঁড়ায়। যতীন দাস পার্ক স্টেশনে কিছু মানুষ ওঠার ফলে ভদ্রলোকও খানিকটা সরে আসেন সুকন্যার দিকে। সুকন্যা ভারী বিরক্ত হয় এবার, দু'পা আরও সরে দাঁড়ায়। আড়চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকায়। কি আশ্চর্য ! ভদ্রলোক এখনো অপলক চেয়ে আছেন তার দিকে তাকিয়ে। রাগে গা জ্বলে যায় সুকন্যার। বিরক্তি ভাবটা কাটাতে ব্যাগের চেন খুলে নিজের মোবাইল ফোনটা বের করে ঘাঁটতে থাকে আর মনে মনে ভদ্রলোকের প্রতি বাংলা ভাষার অন্য প্রয়োগ করতে থাকে। 

পরবর্তী স্টেশন নেতাজি ভবন, প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে....... 

খানিক বাদে কামরার বাঁদিকের দরজা দিয়ে আরও কয়েকজন যাত্রী ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই সুকন্যাকে এবার ডানদিকে সরে দাঁড়াতে হয়। দু'পা দূরত্ত্বে সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। সুকন্যা গম্ভীর হয়ে বলে, "আপনি একটু সরে দাঁড়াবেন প্লিজ" ? 

"আমায় বলছেন ! কেন, আমি তো সরেই দাঁড়িয়েছি"। ভদ্রলোকের স্বরে চাপা কৌতুকের ইঙ্গিত। 

সুকন্যার কান লাল হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বলে, "না, সরে দাঁড়ানোটা যথেষ্ট নয়। বেসিক ডিস্ট্যান্সটা মেন্টেন করুন একটু"। 

ভদ্রলোক রসিক ভঙ্গিতে জবাব দেন, "বেসিক ডিসট্যান্স বলতে যদি আপনি ছ ফিটের দূরত্ত্ব বোঝান তাহলে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সেটা কতটা সম্ভব হচ্ছে তা আপনিই বলুন"।

ভদ্রলোক যে কথাটা ভুল কিছু বলেননি, এটা সুকন্যা মনে মনে বুঝলেও বাইরে তা প্রকাশ পেতে দেয় না।

আশেপাশে যে কজন যাত্রী দাঁড়িয়েছিল তারা সকলেই প্রায় ঘাড় নেড়ে সহমত প্রকাশ করে ভদ্রলোকের কথায়। মুহূর্তে কামরায় একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়। একেবারে টাটকা বিষয়ের ওপর রেখাপাত করাটা কেউই প্রায় এড়িয়ে যেতে চায় না। বিশেষ করে যেখানে একটা গোটা আস্ত পৃথিবী জড়িয়ে, সেখানে চটজলদি আলোকপাত করাটা আবশ্যিক হয়ে ওঠে।  

সেটা লক্ষ্য করে সুকন্যা আরও খানিকটা গম্ভীর হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বলে, "কিন্তু তাই বলে সামান্য দূরত্ত্ব রাখার সৌজন্যবোধটুকুও দেখাব না আমরা, তাইত" ?

একথায় ভদ্রলোক ভ্রূ কুঁচকে তাকান সুকন্যার দিকে। বিস্ময়ে বিহ্বলতায় খানিকটা দমে যান যেন। গলার স্বরে কৌতুক উধাও হয়ে যায় পলকে। আনমনে বিড়বিড় করে বলেন, "দূরত্ত্ব রাখার সৌজন্যবোধ" !   

"হ্যাঁ, দূরত্ত্ববিধি না মানাটাকে আমরা নানান অজুহাত দিয়ে বেঁধে ফেলেছি, তাই আমাদের যতই সাবধান করা হোক না কেন, আমরা নির্বিচারে সেসব জলাঞ্জলি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে রাখি। এতে অবশ্য আর কিছু না হোক, আপনার মতো লোকেরা খানিকটা তামাশার খোরাক পেয়ে যান, আর বাকিদের জন্য সেটা খুবই বিব্রতকর হয়"। একটানা কথাগুলো বলে থেমে যায় সুকন্যা। শব্দের তীক্ষ্ণতায় কামরার গুঞ্জন খানিক নিভে আসে।  

ভদ্রলোক আর কোনো কথা বলেন না। মুখ ফিরিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকেন। টানেলের দেওয়ালে খোপকাটা চৌকো আলোর সারি স্মৃতির মতো পরপর সরে যেতে থাকে তীব্র গতিতে। যে চোখে বিদ্রুপ খেলা করছিল কিছুক্ষন আগেও, সেখানে ঘনিয়ে আসে বিষণ্ণতার ধূসর। ট্রেন চলতে থাকে নির্বিবাদ দুরন্ত গতিতে, সমান লয়ে কামরার মধ্যে যান্ত্রিক শব্দের ছন্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে একটানা। 

বাইরে পরপর কিছু স্টেশন বদলে যায় প্রেক্ষাপটের মতো। যাত্রী সংখ্যা কিছুটা কমে যাওয়ায় দুজনের মাঝখানে ব্যবধান বাড়ে। যোগ্য জবাব দেওয়ায় সুকন্যা মনেমনে পরম তৃপ্তি পায়। উটকো আলগা কথাবার্তাকে কখনোই সে পাত্তা দেয়নি, বিশেষ করে যেসমস্ত দিশাহীন আলোচনা শক্ত পাথরের মতো তার দিকে উড়ে আসে সেসব নিমেষে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তার অনমনীয় ব্যক্তিত্বের প্রভাবে। এক মুহৃর্ত আড়চোখে সুকন্যা দেখে নেয় সেই ভদ্রলোককে। একইরকম ভাবে নির্লিপ্ত হয়ে তাকিয়ে আছেন অন্যদিকে। তাচ্ছিল্যের হাসি অধরপ্রান্ত ছুঁয়ে যায় সুকন্যার। 

পরবর্তী স্টেশন মহাত্মা গান্ধী রোড, প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে....... 

সুকন্যা দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। অভ্যাসমতো ডিজিটাল স্ক্রিনে চোখ যায়, তারপর বাঁহাতের কব্জিতে সময় মেপে নেয় একপলক। কাঁটায় কাঁটায় দশটা বাজে। সুতরাং হাতে এখনো আধঘন্টা মতো সময় আছে। ক্যান্টিনে গিয়ে চট করে কিছু খেয়ে নিতে হবে, তারপর সোজা ক্লাসে। দরজা খোলার সাথে সাথে ট্রেন থেকে নেমে এগিয়ে যায় এস্কেলেটরের দিকে। কয়েক পা এগোনোর পর কে যেন পিছন থেকে ডাকে। 

- এই যে শুনছেন !! হ্যালো ?.... হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি......

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সুকন্যা। কি আশ্চর্য ! ট্রেনের সেই ভদ্রলোক ! ব্যস্ত হয়ে সুকন্যার দিকে এগিয়ে আসছেন। 

'কি ব্যাপার' ! কঠিনস্বরে জিজ্ঞেস করে সুকন্যা। 

- আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। 

- আমাকে ?

- হ্যাঁ, মানে... না বললে আর বলা হবে না বোধহয়।  

- ওহ ! এতক্ষন ধরে আমাকে দেওয়ার মতো উত্তর খুঁজছিলেন, আর তাই এসেছেন আবার নতুন করে কথা বাড়াতে ? শুনুন মিস্টার ! আপনার সাথে অপচয় করার মতো সময় বা ধৈর্য কোনোটাই আমার নেই। তাই মাপ করবেন। 

ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে বলেন, 'না না, আপনি দূরত্ত্ব রাখার কথা বলছিলেন না ? জানেন, আমি সেই দূরত্ত্বটা প্রায় সাতাশ আঠাশ বছর ধরে মেন্টেন করে আসছি। আমার কথা দেওয়া ছিল যে, আর আজ অবধি সে কথার খেলাপ করিনি কখনো। তাই আপনার দূরত্ত্ববিধির কথাটা আমার ক্ষেত্রে ঠিক খাটে না, তাই না' ? 

চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করে সুকন্যা, 'তার মানে ? কি ভুলভাল বকছেন' ?

- মানেটা বরং আপনি সুভাকে জিজ্ঞেস করবেন।

- সুভা ?

- হ্যাঁ সুভা..... মানে সুপ্রভা...... সুপ্রভা বাগচী....আপনার মা ! 

সুকন্যার কানের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে যেন। চরম বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে কয়েক মুহূর্ত। তারপর মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, 'আপনি আমার মা কে কিভাবে চেনেন' ?

স্মিত হাসেন ভদ্রলোক, বলেন, 'আমি যে আপনাকেও একরকম চিনি সুকন্যা'। 

একথায় প্রায় নিশ্চুপ হয়ে যায় সুকন্যা। অকাশপাতাল ভেবেও বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পায় না। মনের মধ্যে নানান চিন্তার ঢেউ তোলপাড় করতে থাকে। যে অপরিচিতের সাথে খানিক্ষন আগে যুক্তিতর্কের পাঞ্জা কষে এল সে কিনা তার নাড়িনক্ষত্র চেনে ! 

'কই আগে তো একে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না', মনে মনে ভাবে সুকন্যা। ভদ্রলোক স্মিত হেসে বলে ওঠেন, 'যদি সময় দেন তাহলে মনের ভার কিছুটা লাঘব করতে পারি, আপনারও....... আর সাথে আমারও'। বাঁ হাত দিয়ে অনতিদূরে একটা প্ল্যাটফর্ম সিট দেখান ভদ্রলোক। সুকন্যা বাধ্য ছাত্রীর মতো সেখানে গিয়ে বসে পড়ে। 

'তুমি বললে অসুবিধে নেই তো ? আপনি আমার থেকে অনেকটাই ছোট', ভদ্রলোক সম্মতি চেয়ে নেন। সুকন্যা বিনা বাক্যব্যয়ে ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। যে কিছুক্ষন আগেও দাবানলের মতো জ্বলছিল, ঘটনার আকস্মিতায় সে এখন মাঝসমুদ্রের মত স্থির। একটা সিট ছেড়ে পাশের সিটে বসেন অপরিচিত বয়স্ক। তারপর ধীরে ধীরে শুরু করেন.....

'নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি, তখন আমি চুটিয়ে থিয়েটার করছি। কলকাতা শহরের বুকে যে কটা নামকরা দল ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল নাট্যদর্শন, হয়ত তুমি নাম শুনে থাকবে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা শো করে বেড়াতাম। সেবার পুজোয় আমাদের জলপাইগুড়ি যাওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অভিনেত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাদের পরিচালক সুপ্রভাকে নিয়ে আসেন। সুপ্রভার বাবা অর্থাৎ তোমার দাদু নারায়ণ সরকার ছিলেন পরিচালকের সহৃদয় বন্ধু। ভীষণ রাশভারী মানুষ ছিলেন। প্রথমটায় সটান নাকচ করে দিলেও পরে  কতকটা নিমরাজি হয়ে সুভাকে পারমিশন দেন। রিহার্সালেই আমাদের প্রথম আলাপ। দিনের পর দিন মহড়া, একসাথে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, সমস্তটা জুড়ে একটা নতুন সম্পর্কের গন্ধ পেতে থাকি আমরা দুজনে। 

জলপাইগুড়িতে আমাদের শো দারুন হিট হয়। ফিরে এসে আমরা নিয়মিত বাইরে দেখা করতে শুরু করি। তখন সুভা মাস্টার্স পড়ছে। সুতরাং অসুবিধে হয়নি খুব একটা। প্রায় বছর দুই পর আমরা মনস্থির করি যে এবার বাড়িতে জানাব। আমাদের সমস্ত স্বপ্ন মিথ্যে করে দিয়ে তোমার দাদু এই সম্পর্কটা মেনে নিলেন না। স্থায়ী রোজগেরে পাত্র ছিলাম না, তাছাড়া থিয়েটারটা ভালবেসে করতাম, দু পয়সা কামাব বলে মঞ্চে উঠিনি কখনো। নিরুপায় হয়ে ঠিক করলাম তোমার দাদুর অমতেই সুভাকে বিয়ে করে নিজের বাড়িতে তুলব। সুভা রাজি ছিল, সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। 

হঠাৎ এর কয়েকমাস বাদে তোমার দাদুর হৃদরোগ ধরা পড়ল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে সুভাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে আমাদের যেন কখনোই বিয়ে না হয়। হ্যাঁ, শুনতে ঠিক সিনেমার মতো লাগলেও কতকটা সেরকমই ঘটেছিল। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল সেদিন। তবে আমি সম্মানহানি করিনি কারোর। ওই যেটা তুমি ট্রেনে বলছিলে - সৌজন্যবোধ, ঠিক ওই কারণেই কিছু করে উঠতে পারিনি। শুধু দগ্ধ হয়েছি তিলে তিলে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সুভা দুরত্ত্ব রাখার কথা দিয়েছিল ওর বাবাকে, আর আমি কথা দিয়েছিলাম সুভাকে। যার অন্যথা আজ অবধি হয়নি।

সুকন্যা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, 'আ....আপনার নাম' ?

- প্রশান্ত....প্রশান্ত চৌধুরী। 

মাথাটা টলে যায় কেমন সুকন্যার। এই নামটা তো সে বহুকাল আগে শুনেছে মায়ের কাছে। বিস্তারিত না হলেও ভাষাভাষা একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল তার মনে। প্রশান্তকে বড় চাক্ষুষ দেখার ইচ্ছা ছিল সুকন্যার। আজ সে ইচ্ছা এভাবে পূরণ হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। কি করবে সে ? মা কে জানাবে ? ওনাকেই বা কি বলবে এখন ? এই হেমন্তের সকালে সুকন্যার বুকে কালবৈশাখীর দামামা বেজে ওঠে। অধীর উত্তেজনায় গলাটা কেমন শুকিয়ে আসে। কোনোরকমে জিগ্যেস করে, 'তারপর' ?

- তারপর তোমার দাদু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার মাস দুয়েকের মধ্যেই ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে দেন সুভার। আমি আরো কিছুকাল থিয়েটারটা চালিয়ে যাই একইভাবে। পরবর্তীকালে দলটা ভেঙে যাওয়ায় কোনোক্রমে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়ে শহরের বাইরে চলে যাই। 

- আর বিয়ে ?

- সেসব আর করা হয়ে ওঠেনি। বলতে পারো হৃদয় থেকে আর কখনো কোনো সাড়া পাইনি। 

- কিন্তু আমায় চিনলেন কি করে ?

-  গত পরশু তোমায় মেট্রোয় দেখে চমকে উঠেছিলাম। অবিকল তরুণী সুভার মুখ। যেমন ঋজু ভঙ্গিমা তেমনই বলিষ্ঠ চলন। তোমার ওই হ্যান্ড ব্যাগের ট্যাগে সুকন্যা বাগচী লেখা দেখে সন্দেহ হয়েছিল। শুনেছিলাম দক্ষিণ কলকাতার কোনো এক বাগচী পরিবারের সাথে সুভার বিয়ে হয়। পদবীটা মনে ছিল। তাই তোমার নামটা পরখ করতে একদিন ফেসবুকে তোমায় খুঁজলাম। ফোটো সেকশনে তোমার মায়ের সাথে তোমার কয়েকটা ছবি ছিল। এত বছর পরেও সুভাকে চিনতে আমার এতটুকু ভুল হয়নি। 

এ পর্যন্ত বলে প্রশান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বেশ কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা। একটা ট্রেন এসে দাঁড়ায় উল্টোদিকে । কিছু যাত্রী নামে........দুরত্ত্ব বজায় রেখে যে যার নিজেদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। খানিক বাদে নীরবতা ভেঙে সুকন্যা জিজ্ঞেস করে -

- কিন্তু এতবছর আগের কথা এতদিন ধরে কেন এভাবে বয়ে বেড়ালেন ?  কি পেলেন আপনি ?

একথার কোনো উত্তর দেন না প্রশান্ত। কিছু কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না বোধহয়। 'কি পেলেন' কথাটা যেন ভারী ধাতব শব্দ করে ঝড়ের মতো উড়িয়ে নিয়ে চলে যায় স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনটা। প্রশান্ত নির্বাক বসে থাকেন সে দিকে তাকিয়ে।  

সুকন্যা ধীরে ধীরে বলে, 'আপনি কি একবার কথা বলবেন মায়ের সাথে, নাম্বার দেব' ?

- না সুকন্যা, কথা বলার হলে নাম্বার আমি আগেই জোগাড় করতে পারতাম। বরং সামাজিক দূরত্ত্বটা বজায় থাক, যে সময়টা চলে গেছে তাকে ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়। আর এতদিন বাদে তার কোনো অর্থও আমি দেখি না।

তুমি বরং এগোও, তোমায় আর দেরি করাব না। তোমার সাথে কথা বলব বলে আমি আমার স্টেশনের আগেই নেমে পড়েছি। পরের ট্রেনের জন্য এখানেই ওয়েট করি বরং। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগল......ভালো থেকো.....

সুকন্যা কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। টালমাটাল করতে থাকে মাথাটা। ধীরে ধীরে সিট্ ছেড়ে উঠে পড়ে। দোনোমোনো করে বলে, 'কাল কি আপনি একই টাইমের মেট্রো ধরবেন' ?

- নাহ, তার আর প্রয়োজন পড়বে না। আগামীকালের ফ্লাইটে আমি দিল্লি ফিরে যাচ্ছি। কলকাতায় কয়েকদিনের জন্য একটা কাজে এসেছিলাম। আমার সব কাজ শেষ হয়েছে...  

- ওহ ! আচ্ছা.....বেশ...... আমি চলি তাহলে........ ভালো থাকবেন......

কোনোরকমে কথাগুলো বলে সুকন্যা। করজোড়ে একটা নমস্কার করে সামনে এগিয়ে যায়। টিকিটিং মেশিনে চেক আউট করার আগে একবার পিছন ফিরে দেখে। ভদ্রলোক ক্লান্ত মুখে বসে আছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে যায় সুকন্যা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ব্যাগের মধ্যে ফোনটা বেজে ওঠে। 

- হ্যাঁ  মা। 

- কিরে ! তুই ফোন করলি না ? এখনো ইউনিভার্সিটি ঢুকিসনি ?

- নাহ, আজ একটু দেরি হল...... 

- কেন রে ? ট্রেন লেট্ ?

- না, ট্রেন ঠিক সময়ই এসেছিল, দূরত্ত্বটা বুঝতে অনেকটা দেরি হল। 

- কি আবোলতাবোল বলছিস ? কি হয়েছে ?

- প্রশান্ত চৌধুরীর সাথে দেখা হল মা। তোমার মনে আছে তুমি যার কথা আমায় বলেছিলে ?

'কে !.......কার সাথে দেখা হল ? কি নাম বললি' ? গলাটা সামান্য কেঁপে যায় সুপ্রভার। এত বছর পর পুরোনো একটা নাম শুনে মাথার ভেতরটা কেমন যেন ওলোটপালোট হয়ে যায়। 

- হ্যাঁ, তুমি ঠিকই শুনেছ। প্রশান্ত চৌধুরী। অদ্ভুতভাবে মেট্রোয় দেখা হল জানো। 

- মেট্রোয় দেখা হল ??.......তার মানে প্রশান্ত কলকাতায় !! কিন্তু আমি যতদূর জানতাম ও তো কলকাতার বাইরে চলে গিয়েছিল !

- হ্যাঁ আমাকেও তাই বললেন। কদিনের জন্য এসেছিলেন। কালই ফিরে যাচ্ছেন। জানো তোমাদের দুজনের পুরোনো দিনের অনেক কথা বললেন। তোমাদের প্রথম দেখা, রিহার্সাল, নাটক, আরও কত কি।

- তোর সাথে এতো কথা হল !

- হ্যাঁ, হল তো । তুমি কথা বলবে একবার ? তুমি চাইলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। নিচে প্ল্যাটফর্মে বসে আছেন পরের ট্রেনের জন্য.............. কি ?.... কথা বলবে ?

'বলব বলছিস ! পারবি তুই ? পারবি একবার কথা বলিয়ে দিতে ! ছুটে যা না তাহলে একবারটি ! বল আমি কথা বলতে চাইছি', কাতরস্বরে বলেন সুপ্রভা, 'বলতে না চাইলে বলবি আমাদের প্রায়শ্চিত্ত শেষ হয়েছে' !

গুপ্তধন ফিরে পাওয়ার উত্তেজনায় সুপ্রভা ছটফট করতে থাকেন মনে মনে। পুরোনো যা কিছু গ্লানি, অভিমান তার কিছুটা বোধহয় লাঘব করার সময় এসেছে এবার। সুপ্রভার দুচোখ বেয়ে অপেক্ষার ধারা নেমে আসে।

'আচ্ছা দাঁড়াও আমি দেখছি', বলে সুকন্যা ফিরে যায় সিঁড়ির দিকে। ফোনে কথা বলতে বলতে প্রায় স্টেশনের গেটের কাছে এসে গেছিল। এখন অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আবার চেক ইন করতে হবে। কোনোরকমে কাঁধের ব্যাগটা সামলে সিঁড়ি বেয়ে সে তরতর করে নামতে থাকে। ডানদিক ঘুরে আবার কয়েকটা সিঁড়ি। সেখান থেকে নেমে একটা বাঁক ঘুরে তারপর টিকিটিং মেশিন। পড়িমরি করে ছুট লাগায় সুকন্যা। স্টেশনের ডিজিটাল টাইমারে এখন সময় দশটা আটত্রিশ। উনচল্লিশে পরের ট্রেন। সামনে জনা দশেকের লাইন। "ওহ ভগবান ! কি করি ! হাতে আর এক মিনিট সময় আছে", মনে মনে অস্থির হয়ে ওঠে সুকন্যা । লাইনের পিছনে পিছনে এগিয়ে গিয়ে কার্ড পাঞ্চ করে ভিতরে ঢোকে। সামনে আরও কিছু সিঁড়ি পেরিয়ে তবে নিচে প্ল্যাটফর্ম। 

ট্রেনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে যেন ! 

দুরন্ত গতিতে নিচে নেমে আসে সুকন্যা । ট্রেন ঢুকে পড়েছে ততক্ষনে প্ল্যাটফর্মে। সুকন্যা দৌড়ে যায় সেই প্ল্যাটফর্ম সিটটার দিকে। সিটিটা খালি ! কোথায় গেলেন প্রশান্ত। কি আশ্চর্য ! এই তো বসে ছিলেন। ট্রেনে উঠেছেন তো আদৌ ! ট্রেনের দরজা খুলে যায়। কামরাগুলো থেকে বেশ কিছু যাত্রী বেরিয়ে আসে। সুকন্যা পাগলের মতো প্রত্যেকটা কামরার দরজার কাছে গিয়ে খুঁজতে থাকে প্রশান্তকে। কোথায় গেলেন ভদ্রলোক ! যান্ত্রিক শব্দ করে কয়েক সেকেন্ড বাদেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ প্রশান্তকে দেখতে পায় সুকন্যা। পরের কামরায় জানলার দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন। 

দূর থেকে সুকন্যা আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে, 'প্রশান্তবাবু !! প্রশান্তবাবু !! আপনার ফোন এসেছে। ........ প্রশান্তবাবু......' !

কঠিন পুরু কাঁচের জানলা ভেদ করে শব্দেরা ভিতর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। ট্রেন চলতে শুরু করে । সুকন্যা পাশে পাশে দৌড়তে শুরু করে..... 'প্রশান্তবাবু........আপনার ফোন......একবার কথা বলুন প্লিজ .....একটিবার অন্তত.......প্রশান্তবাবু.........' !

ট্রেন গতি বাড়ায়, সুকন্যাও কোনোরকমে টলোমলো পায়ে ছুটতে থাকে......'প্রশান্তবাবু আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন ???'.............ফোনটা ধরুন প্লিজ.!!.......... আপনার প্রায়শ্চিত্ত..............' কথাটা শেষ করতে পারে না সুকন্যা। মেট্রো পুলিশ ছুটে এসে পথ আটকায়। ট্রেন ক্রমশ গতিবেগ বাড়িয়ে উল্কার মতো ছুটে পাতাল প্রান্তের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। 

'প্রশান্তবাবুউউউউউ ............' !!!!! 

সুকন্যার ব্যর্থ মর্মন্তুদ হাহাকার প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে আছড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িযে পড়ে ............মাঝের দুরত্ত্বটা মহাকাশের কৃষ্ণগহ্বরের মতো একটানা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বেড়েই চলে.........বাড়তেই থাকে ক্রমশ..........

গ্রাফিক্স : নিজস্ব 

#bengalishortstories #bengalilovestories #bengalishortfilmscript #Molat #DebdattaSinha


Friday, July 10, 2020

অনুপদ্য - ২৩

রুদ্ধ দ্বার, অনন্ত সময়ের ঘর 
ছিন্ন বিকেল, পড়ে থাকুক অতঃপর 
যতটুকু ব্যয় ছিল, তারও কম সঞ্চয় 
অবকাশ যাপন, সুপ্ত স্বল্প ভয় 

দেখাই যাক না কি হয়......

কোথাকার জল কোথায় গিয়ে মেশে 
বিপরীত প্রান্তর যদিও বেজায় সর্বনেশে 
দুর্ণিবার ঝড়ে যেখানে গোটা দেশ মরে 
সেখানে আরও কটা দিন লাগুক নাহয় 

দেখাই যাক না কি হয় !


 















ছবি : নিজস্ব 

#bengalishortpoems #molat #debdattasinha #lockdownpoems

Friday, April 3, 2020

বসন্ত আটকে গেছে

এই আশ্চর্য দুনিয়ায় নানান জিনিস দেখার আছে। তবে চোখ বুজে যে সব জিনিস দেখতে পাই তাদের মধ্যে অন্যতম হল স্বপ্ন। সে স্বপ্ন নীল আকাশে বকের ডানায় ভর দিয়ে উড়ে বেড়াক বা অন্ধ গলির বাঁকে হুমড়ি খেয়ে পড়ুক, স্বপ্ন দেখতে আমার বরাবরই দিব্যি লাগে।  

তবে কিনা আমি শান্তিপ্রিয়, নির্বিবাদী, ল্যাদখোর বাঙালি। নিত্যদিনের অফিস আর সংসারের আওতায় নিজের জীবনটাকে আচ্ছা করে গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলেছি। এর থেকে বেশি লংজাম্প দিয়ে হনুমানের মতো গন্ধমাদন বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়, বা হলেও তেমন কোনো ইচ্ছে মনের মধ্যে পোষণ করি না। সারা সপ্তাহ নানান চাপের জোয়াল কাঁধে বয়ে রোববারের বারবেলাটুকু কচি পাঁঠার লাল লাল ঝোলের তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারলেই নিশ্চিন্তি, অর্ধেকের বেশি যুদ্ধ আমার ওখানেই জেতা হয়ে যায়। এর ওপর রয়েছে সিনেমা, শপিং মল, রেস্তোঁরা ও বছরে একবার পারিবারিক ভ্রমণের অব্যক্ত উত্তেজনা। তার ওপর যদি প্রসংশার মালা গলায় ঝোলে তাহলে তো চোখের জল মাপতে চিবুকের নিচে বাটি ধরতে হয় আমাকে ।

কিছু কিছু স্বপ্ন আমার যেমন আওতার মধ্যেই থাকে। এই ধরুন বন্ধু জুটিয়ে দুম করে বেপাত্তা হয়ে যথেচ্ছ বেলেল্লাপনা করে ফিরে আসা অথবা চিলেকোঠার ঘরে চুপচাপ নির্বিবাদ ল্যাদ খেতে খেতে বই পড়া বা খানিক লেখালিখি করা ইত্যাদি। যদিও এসব ক্ষেত্রে সাফল্যের হার নিচের দিকেই থাকে, তবু এ সমস্ত স্বপ্ন দেখতে আমি বিন্দুমাত্র কসুর করি না, কারণ ওটুকুতেই আমার স্বর্গলাভ হয়।
 
বরং সেই সমস্ত স্বপ্ন আমি দেখিই না যেগুলো আমার আওতার বাইরে। এই যেমন মার্চ মাসের গোড়ার দিকে আমাদের জীবনে রে রে করে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ল করোনাভাইরাস নামক একধরণের সাইক্লোন যা আমাদের সমস্ত হিসেবের খাতা এক নিমেষে ওলোট পালট করে দিশেহারা করে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চব্বিশ ঘন্টার জনতা কার্ফ্যু, তার পরেই ৩১শে মার্চ অবধি ট্রেন-মেট্রোর বন্ধ ঘোষণা আর তার দুদিন কাটতে না কাটতেই একেবারে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন।

চোখ মুখ একযোগে ঝাপসা হয়ে গেল আমার। প্রথমটায় খানিক থম মেরে গেলেও ধীরে ধীরে প্রাথমিক শকটা কাটিয়ে উঠে এই সময় ঠিক কি করা প্রয়োজন তার একটা লিস্ট আমি মনে মনেই বানিয়ে ফেলে ছিলাম। সঙ্গে আগামী ২১ দিন কি কি অসুবিধে হতে পারে আর কেমন করে সেগুলো ডজ করে বেরোতে হবে এটাও ভাবতে আমার দু মিনিটের বেশি সময় লাগে নি।

আমি নিশ্চিত, এসময় অনেকেই হয়ত আমার মতো চিমটি কেটে দেখেছেন নিজেদের, এই ভেবে, যে স্বপ্নটা কি বেশি দেখা হয়ে গেল নাকি ? কাল রাতে ভুল করে কিছু খেয়ে ফেলিনি তো বাপ্ ! ভিতরে ভিতরে অনেকেই নির্ঘাত ভেবেছেন - ২১ দিনের অপরিমিত ল্যাদ ! মাইরি ! ঠিক শুনছি তো ?

টানা বেশ ক'দিন রুটি আর পানসে তরকারি খাওয়ার পর হঠাৎ করে যদি গরম ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানি পাতে পড়ে, তখন মুখ চোখের ওপর যেমন চরম উল্লাসের মানচিত্র ফুটে ওঠে এ খবর শোনার পর আমারও প্রাণটা চড়াই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে শরীর থেকে বেরিয়ে সারা ঘর নেচে কুদে আবার বুকের মধ্যে সেঁধিয়েছিল। যতটা পেরেছি মুখ চোখ ভাবলেশহীন রেখেছিলুম। কি জানি, বেশি আমোদ করলে আবার লোকে বলবে,কেমন মানুষ তুমি বাছা ? সারা দেশে যুদ্ধ লেগেছে, লোকজন মরতে বসেছে , মানুষের চাকরি থাকবে কিনা ঠিক নেই, খাবার পাব কিনা জানা নেই আর তুমি ল্যাদ খাবে বলে তার সুখটানের খুসবু ছড়াচ্ছ চাদ্দিকে !

আহ, সে চিন্তা কি আর আমার নেই বলে ভাবছেন ? আছে গো কত্তা আছে, বরং আমার এবং আমার মতো আরও অনেকেরই আছে। চাকরি পেতে আর সেইটা ধরে রাখতে কি কি করতে হয় সে আর আমাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে ! আর খাবার ? সে তো সরকার বন্দোবস্ত করছে । সুতরাং সারা সপ্তাহ পাহাড়প্রমাণ চাষের পর ওটুকু ল্যাদের স্বপ্ন বলদও দেখে থাকে, আমরা তো কোন ছার !

যাগ্গে যাক, যে কথা হচ্ছিল.............তো সময়মতো লকডাউন হল। আর আমার মনের মধ্যে অযাচিত ভাবেই 'দোলে মন দোলে, অকারণ হরষে…' এর মতো অবস্থা হতে লাগল।

এই গোটা সিজনে আমার ক্যালকুলেশনে চরম ভুলটা ওইখানেই হল। ওয়ার্ক ফ্রম হোম ডিক্লেয়ার ছিল আগে থেকেই আর তার সাথে ছিল শেষ না হওয়া কাজের লিস্ট। তাই সকাল বিকেল কতকটা নারায়ণের মতো আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপের সামনে ধ্যানগম্ভীর মুখ করে কাজ করলাম। কাজের সময়টুকু শেষ হবার পর পরই লাগামছাড়া গরুর মতো সারা বাড়ি পায়চারি করে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগলাম, ভাবটা এমন যে কি কি কাজ বাকি আছে দেখে নিই, সেগুলো এই লকডাউনেই সরে ফেলতে হবে। এছাড়া অতি উৎসাহে ঝাড়পোঁছ, আনাজ কেটে দেওয়া, বাজার করা, গাছে জল দেওয়া, কাপড় শুকোতে দেওয়া আবার নামিয়ে আনা ইত্যাদি বিবিধ গৃহস্থালি কাজে একেবারে পারদর্শী হয়ে উঠলাম।  

তবে বেশ কদিন কেটে যাওয়ার পর আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে যাওয়ার মতো চেতনার উন্মেষ ঘটল যেন। মনে হল,বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে চরে বেড়ানো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু যেমনটা ভাবা হয়েছিল তেমন করে বসন্ত এল কই ????? অর্থাৎ কিনা যে প্রলম্বিত অবসরের কথা ভেবে মনে মনে উত্তেজনার আঁচ পোহাচ্ছিলুম সেতো দুদিন না যেতে যেতেই ফুস করে নিভে গেল। 

উপরন্তু কাজের পরিমান দ্বিগুন হল......তার কারণ কাজের ও রান্নার মাসিরা আগের থেকেই আসব না বলে পেন্নাম ঠুকে রেখেছেন। মধ্যিখান থেকে আমি বলির পাঁঠা হয়ে খামোখাই দিন রাত জবাই হতে লাগলুম। বাড়ির গিন্নি তিন বেলা রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতে লাগলেন এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই যাবতীয় ঠিকে কাজটা আমারই ঘাড়ে এসে পড়ার যোগাড় হল। অতএব যে কাজটা 'বোনাস দিলুম' বলে এক দু'বার করে দিয়েছিলুম সে কাজটাই যেন প্রত্যেকদিন গলার ফাঁস হয়ে চেপে বসতে লাগল। তার ওপর সন্তান ছোট এবং স্কুল যেহেতু ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ, সেক্ষেত্রে তারও অর্দ্ধেক দায়িত্ত্ব এসে পড়ল এই শর্মারই কাঁধে, বোঝো ঠ্যালা ! এ যে ফ্রাইং প্যান টু ফায়ার হয়ে গেল……!  মাইরি বলছি, এমন বসন্ত চেয়েছি বলে তো মনে করতে পারছি না। 

বাড়ি ফিরে অনেক সময়ই বলতাম ‘আজ ব্যাপক স্ট্রেস গেছে, একটু চা করে দিও প্লিজ’। মুশকিলটা হচ্ছে এই বাজারে কোথা থেকে ফিরব আর কাকেই বা বলব ! অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের থেকেই চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিতে হয়েছে। তাতে অবশ্য মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হচ্ছে না, বরং তেমন দেখতে গেলে বলা যায় প্রেম খানিকটা বাড়ছে বইকি…….. এইটাই বা কম কি! তবে ঝামেলাও যে হচ্ছে না তাই বা বলি কি করে....ঘরের বাসন কোসন একত্রে পাশাপাশি রয়েছে অথচ ঝনঝন করে শব্দ হবে না এমন অলীক কল্পনা আমি করি না। এই করেই চলছে....... সাথে গুরুমন্ত্রের মতো কাঁসর বাজানো আর লাইট জ্বালানো তো আছেই......

আমার বিশ্বাস অনেকেরই বাড়িতে একই ঘটনা ঘটছে। যারা ভাগ্যবান এবং এসব তুচ্ছ জিনিসের উর্দ্ধে তাঁদেরকে আমার প্রণাম কিন্তু যাঁরা আমার মতো অন্য বসন্তের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা আপাতত ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রেমটাই ভালো করে করতে থাকুন, আর কি করবেন ? কিছু কিছু স্বপ্ন স্বপ্নই থাকুক নাহয়।

পুনশ্চ : এরই মধ্যে যাঁরা আপৎকালীন পরিষেবার জন্য দিনরাত এক করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে কাজ করে চলেছেন তাঁদের জন্য আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বস্তুত আপনাদের জন্যই এযাত্রা টিকে যাব বোধহয়। 



#bengaliarticle #molat #coronavirus #COVID19 #debdattasinha

Tuesday, October 1, 2019

শর্ট ম্যাসাজ সার্ভিস

পাড়ার সেলুন আর বিউটি পার্লারের মধ্যে বেশ কিছু চরিত্রগত তফাত আছে যা আমরা সকলেই জানি। না না, পরিষেবা ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণের যুক্তিতক্কের ফাঁকে ঢুকতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি, এই দুই প্রতিষ্ঠানের মূল তফাৎ হল আবেগে। খানিকটা আগ বাড়িয়ে বলা যেতে পারে যে পাড়ার সেলুন হল মধ্যবিত্ত বাঙালির অস্থায়ী আড্ডার চরম ঠিকানা, সহজ ভাষায় যাকে বলে - ঠেক। সেখানে 'বাজার আগুন দাদা, কিছু ছুঁলেই হাত পুড়ে যাচ্ছে' অথবা 'কুলদীপের অফ ফর্মটা এবার ওয়ার্ল্ড কাপে বেশ ভোগালো' বা 'যাদবপুরের সিটটা এবার যুক্তিসম্মত হলো না' ইত্যাদি কথাবার্তায় চুল দাড়ির নকশাটা যেন অন্য মাত্রা পায়। সেখানে পার্লারে শুধু কাঁচি চলার শব্দটাই যেন বেশি করে কানে লাগে। তার কারণ বাকিরা ধ্যানগম্ভীর ঋষি মুনির ন্যায় খবরের কাগজ বা স্মার্ট ফোনের মধ্যে অমৃতের সন্ধান পেতে থাকে। তাই পার্লারে যাবতীয় স্বর্গীয় হাতছানি উপেক্ষা করে নিয়মিত ক্ষুরকর্মের জন্য আমি বরাবরই আমার পাড়ার সেলুনগুলোকে অগ্রাধিকার দিই। ভাবছেন, ধান ভাঙতে শিবের গীতটা গাইতে লেগেছি কেন ? বলছি...

এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে যেটা আমার কাছে অন্যতম আকর্ষণ তা হল কুইক ম্যাসাজ। চুল কাটার পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ মানুষেরই ম্যাসাজ নেবার একটা পাশবিক ইচ্ছে জাগে। আর আশ্চর্য জনক ভাবে নাপিত ছেলেটিরও যেন এক নৈসর্গিক আনন্দ হয়। ভাবটা এমন যেন  - 'আহা কি বললে গো দাদা, এটার অপেক্ষাতেই তো ছিলুম'। আর তারপরেই যেটা শুরু হয় তা দিয়ে সহজেই একটা দশ মিনিটের শর্ট ফিল্ম বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে। মাথার চুল পেরিয়ে ঘাড় আর পিঠ অবধি যে অবাধ তবলা বাদন চলে তার মধুর সংগীতের মূর্ছনায় গোটা সেলুনটা যেন সিনেমা হলের মতো লাগে। কারণ যারা চুল কাটার অপেক্ষায় বসে থাকে বা গুলতানি করে তারাও যেন এ দৃশ্যপটের সামনে কিছু মুহূর্তের জন্য বাক্যহারা হয়ে যায়।

ম্যাসাজের প্রতি কোনোরকম স্পৃহা আমার কখনোই ছিল না, তার কারণ শরীরের উপর কোনোরকম  অত্যাচার আমি সইতে পারি না মোটে। আর আমার বলতে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই যে এ যাবৎ এমনধারা ম্যাসাজ আমি ছোটোর থেকে নিই নি কখনো । তবে কপালের ফেরে সে ভয়কর অভিজ্ঞতাও আমার হল একদিন । গত রোববার ল্যাদপ্রিয় মানুষের মতো আমিও একটু দেরিতে বিছানা ছেড়ে ছিলাম। দেরিতে ওঠার ফলেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক মাথাটা বেজায় টনটন করছিল। উঠেই ভাবলাম, সামনে পুজো, যাই, আজ চুল কাটার সাথে সাথে ম্যাসাজটাও করিয়ে নিই। চুল ছাঁটাও হবে সঙ্গে নতুন অভিজ্ঞতাও হবে। কিন্তু কপালটা চিরকাল আমার সাথে বেইমানি করে এসেছে। এবারেও তার অন্যথা হল না।

সেলুনটা আমার বাড়ির পাশেই। সাত ফুট বাই সাত ফুটের একটা ঘর। ছাপা পর্দার আড়ালে ফোর-জি স্পিডে দক্ষযজ্ঞ ঘটে চলেছে। ভিতরে ছটা চেয়ারই ভর্তি। মাঝে একফালি একটা সরু কাঠের বেঞ্চ, সেখানে বসে জনা তিনেক লোক আড্ডায় মশগুল। ডানদিকের চেয়ারে একটা কাঠের পাটাতনের ওপর একটা পুঁচকে ছেলে ঘাড় গুঁজে বসে, আড়চোখে সামনের আয়নায় আঁখো দেখা হাল এর বিশদ বিবরণী মেপে নিচ্ছে। পাশে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে,  খুব সম্ভব ছেলেটির মা, যিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরামর্শ দিয়ে চলেছেন নাপিতকে। মধ্যবয়সী নাপিত বেচারা চেয়ারের চারপাশে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। দেওয়ালে লাগানো প্রীতি জিন্টা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। বাঁদিকের দেওয়ালে আমির আর শাহরুখ আলাপচারিতায় মগ্ন। দক্ষিণ পূর্ব কোণে একটা স্পিকার ঝুলছে। যেটা দেখে আমার প্রত্যেকবার মনে হয় সেটা যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়ে যাবে, কিন্তু আশ্চর্য ভাবে মাধ্যাকর্ষণ এর সমস্ত থিওরি ভুল প্রমাণিত করে দিনের পর দিন টিকে আছে সে এইভাবেই। সেটা দিয়ে নব্বইয়ের দশকের হিন্দী গান ভেসে আসছে। সবটা মিলিয়ে একেবারে মাখ মাখো মধ্যবিত্তের আধার কার্ড।

আমি দরজায় দাঁড়িয়ে পুরোটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। রাজু আমায় দেখে বললে, 'দাদা দো মিনিট ! ব্যাস হয়ে গিয়েছে । একে ছেড়ে দিয়ে ফির আপনাকে ধরছি' ।

রাজু হল অল্পবয়সী খোস মেজাজি বিহারী নাপিত। বয়স ২৬ - ২৭ হবে। শ্যামলা রং, মাঝারি গড়ন, পান মশলায় বেশ আসক্তি আছে। 'একে' বলতে যাকে বোঝালো সেই মাঝবয়সী ভদ্রলোক চুল কাটাতে কাটাতে ভারী বীরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। চোখেমুখে অবজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট । মনে মনে ভাবলেন বোধহয়, কোথাকার কোন নবাব খাঞ্জা খাঁ এসেছি যে মাত্র দুটো মিনিটেই ছেড়ে দিতে হবে ! আমি বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ। অকারণ মাতামাতি সহ্য হয় না।  তবু রাজু আমায় বিশেষ খাতির করে। কি কারণে করে তা বলতে পারব না। হতে পারে আমি তার কাঁচির তলায় নির্বিচারে মাথা পেতে দিই এবং সমস্ত নির্দেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলি। রাজুও দিব্যি খোশগল্প করতে থাকে আমার সাথে। তার কোনো কথায় আমি বাধা দিই না, বরং সে একজন শান্ত নির্বাক শ্রোতা পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহে চুল কাটতে থাকে।

মিনিট দশেক পরে রাজুর চেয়ার ফাঁকা হয়ে যেতে সে একগাল হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকাল। যে ভদ্রলোক বসেছিলেন তিনি পাশ দিয়ে যাবার সময় তির্যক চাউনি ছুঁড়ে দিয়ে গেলেন আমার দিকে। আমিও সামান্য বোকা হাসি দিয়ে চুপচাপ নির্বিচারে বসে পড়লাম চেয়ারে। রাজুর কাঁচির পথচলা শুরু হল।

পিছন থেকে শুরু করে কানের দুপাশ দিয়ে রাজুর কাঁচি নির্বিবাদ চলতে লাগল। আর আমিও সামনের আয়নায় আমার চুলের ব্রেকিং নিউজ প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। পেছনের দেওয়ালে শাহরুখ আর আমির আমার দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে। প্রীতি জিন্টা সমানে মুচকি হাসছে। খানিক বাদে এই খুনখারাপির অবসান ঘটল। বরাবরই আমার চুল কাটতে বিশেষ সময় লাগে না। কমতে কমতে বর্তমান সময়ে এসে মাথার ওপর যে ক'গাছা পড়ে আছে তা ছোটবেলার স্মৃতি আর গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব ছাড়া আর কিছুই নয়। ঘাড়ের চারিদিকে খোঁচাওয়ালা পাউডার লাগিয়ে দিল রাজু। এই জিনিসটা তাকে প্রত্যেকবার বারণ করা হলেও সে শোনে না। খামোখা অত পাউডার লাগিয়ে ফুলবাবু সাজিয়ে ঠিক কি লাভ হয় বুঝিনা। অথবা হয়ত ভাবে, যে এই অবস্থায় ঠাকুর দেখে আসা সম্ভব.....

সমস্তটা হয়ে যাওয়ার পর রাজু জিজ্ঞেস করল, 'ওউর বলেন দাদা.........'

আমি খানিক ইতস্ততঃ করে বললাম, 'ইয়ে মানে তুমি তো ম্যাসাজ করো দেখি। আমার ঘাড় আর মাথার দিকটা একটু করে দিতে পারো......সকাল থেকে বড্ড টনটন করছে'।

রাজুর সারা মুখমন্ডল জুড়ে শরতের রোদ খেলে গেল যেন। আমার এহেন আবদার সে যে কিভাবে পূরণ করবে ভেবেই পেল না। অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললে, 'আরে কি বলছেন দাদা, একদমসে করে দেব। আপনাকে এমন স্পেশাল ম্যাসাজ দেব যে আপনার নেশা লেগে যাবে'।

মনে মনে ভারি আশ্চর্য হলাম, 'ম্যাসাজের নেশা ! এ ব্যাটা বলে কি ! এতেও কি মানুষের আসক্তি আছে নাকি ? অবশ্যি তথাকথিত ম্যাসাজ পারলারের যে সমস্ত খবর কানে আসে তাতে করে ম্যাসাজ বিষম বস্তু হতেই পারে বৈকি'।

সে যাই হোক, রাজু সামনের ড্রয়ার খুলে সযত্নে চিরুনি আর কাঁচি রেখে দিল তাতে। তারপর দু হাত ওপরে তুলে নিজের দশটা আঙ্গুল কটমট করে ফাটিয়ে নিল। ঘাড়টা দুপাশে কাত করে নানান কায়দায় কসরত করে রেডি হয়ে গেল একেবারে। বক্সিং শুরু করার আগে ফাইটাররা যেমন করে থাকে, কতকটা সেই রকম। আমার কেমন বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এ যেন বল্লালদেবকে নিকেশ করার আগে বাহুবলী প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিনেমার দৃশ্যটা ভেবেই আমার গলা শুকিয়ে এল একেবারে। কেবলই মনে হতে লাগল একটু বেশি রিস্ক নিয়ে ফেললাম নাতো !

অবশ্য খুব একটা ভাবার অবকাশ পেলাম না। কারণ ততক্ষনে রাজু দুহাত দিয়ে কপ করে আমার মাথাটা ধরে ফেলেছে। দু আঙুলের মুদ্রায় কপালের সামনেটা টেনে টেনে ধরতে লাগল। তারপর একইভাবে ভাবে কপালের দুপাশে চক্রাকারে আঙ্গুল ঘোরাতে লাগল। বেশ আরাম পেলাম। মনে মনে রাজুর প্রতিভার তারিফ না করে পারলাম না। এরপর মাথার পিছন দিকটায় দু হাত দিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে জড়ো করে আঙুলের বিশেষ কায়দায় চটপটি বাজনার মতো করে ফটাফট শব্দ করতে লাগল। মাথার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি বিসমিল্লাহ খাঁর সানাইয়ের তরঙ্গ খেলে গেল যেন। দু চোখে অপার শান্তির ঘুম নেমে এলো আমার। কয়েক মুহূর্ত সেলুন আর স্বর্গের তফাৎ করতে পারলাম না।

বেশ খানিকক্ষণ এমনটা হবার পরে রাজু আমার কাঁধের দিকে নেমে এল। ফেনিল মসৃন ঢেউয়ের মতো সে আমার কাঁধের ওপর ছোট ছোট অবকাশে আঙ্গুল চালাতে লাগল। এমন স্তিমিত মৃদু অঙ্গুলিচালনায় মনে মনে একেবারে নিশ্চিত হলাম যে ম্যাসাজ কম্পিটিশনের ওয়ার্ল্ড কাপটা একমাত্র রাজুরই পাওয়া উচিত। এমন চমৎকার ট্যালেন্ট বুড়োশিবতলার গলিতে অবহেলায় ও অযত্নে নষ্ট হচ্ছে ভেবে মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল।

হর্ষ আর করুণার দোলাচলে দুলতে দুলতে আমার অন্তরাত্মায় প্রগাঢ় আবেগ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আমার দু কাঁধের ওপর নেমে এলো বিরাশি সিক্কার দুখানি রাম রদ্দা । কতকটা সাংঘাতিক ঠোক্কর খাওয়ার মত মালুম হল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, আধা চোখ খুলে বললুম, 'ওরে আস্তে রে পাগল ! অমন করে কেউ মারে' ?

রাজু অকপট ভাবে বলল, 'এতক্ষন মেলোডি ছিল দাদা, এইবার রক দিচ্ছি'।

একথায় আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্ট্যাচুর মতো নিশ্চল হয়ে গেলাম। সে প্রাণান্তকর কথা অনুধাবন করতে খানিক সময় লাগল আমার মতো মূর্খের। যতক্ষণে বুঝতে পারলাম ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে অনেক। দু কথা বলার অবকাশ পর্যন্ত সে দিল না আমায়। তার আগেই আমার বাঁ হাতটা টেনে ধরে গামছার জল নিংড়ানোর মতো করে মোচড়াতে শুরু করলে। আমার চোখে কালবৈশাখীর আঁধার নেমে এল প্রায়।

ঢোঁক গিলে বললুম, 'একি কচ্ছিস রাজু ? হাতটা তো খুলে যাবে মাইরি' !

রাজু খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে বলল, 'কি যে বলেন দাদা, হাত আবার অমনি খুলে যায় নাকি ! একি টেবিলের ড্রয়ার না আলমারির দরজা, যে টানলাম আর খুলে গেল' !

আমি প্রায় হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলাম, বললুম, 'ছেড়ে দে সোনাভাই আমার, ছেড়ে দে আমায়, যথেষ্ট হয়েছে আমি আর ম্যাসাজ নিতে চাইনা, এই অবধিই নেওয়ার ছিল আমার, আজ আর নয়.......'

রাজু শোনার পাত্র নয়। ঘাড় নেড়ে বললে, ' তা বললে কি হয় দাদা, এতদিন বাদে আপনি ম্যাসাজ নিচ্ছেন, অমন ছেড়ে দেয়া যায় নাকি ? সবে তো শুরু হল, এবার পিঠটা ভালো করে চাপড়ে দলাই মলাই না করলে মনেই হবে না যে ম্যাসাজ হচ্ছে'।

আমি কাতর ভাবে রাজুকে বললাম, 'দ্যাখ রাজু, এতদিন ম্যাসাজ নিইনি মানে এই নয়, যে আজ আমাকে পুরোটা উসুল করে নিতে হবে। আর তাছাড়া খামোখা আমার পিঠ চাপড়ে কি করবি বল ? বলার মতো তো তেমন কোনো কাজ করে উঠতে পারিনি আমি, সুতরাং অত তরিবত না করলেও চলবে......... আ - আমায় ছেড়ে দে ভাইটি.....'

রাজুর প্রত্যয়ী মুখে চোখে তেমন কোনো ভাবাবেগ লক্ষ্য করা গেল না। তবু আমি চেষ্টা করতে ছাড়লাম না। ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, 'শোন না, লক্ষ্মী ভাইটি, আমার না হঠাৎ একটা অফিসের কাজ মনে পড়েছে, বাড়িতে গিয়ে চট করে করতে হবে বুঝলি, আজ ছেড়ে দে, পরে নাহয় অন্য কোনো একদিন..........'

রাজু আমার ছেলে ভোলানো কথাকে অবলীলায় ডজ করে বেরিয়ে গেল। বলল, 'না দাদা, রোববারে আবার অফিসের কাজ কি, আর এতো কাজ করে করেই তো পিঠে ব্যথা হয়েছে। এরপর তো কোমর আছে, আপনি আরাম করে বসুন না, ঘাবড়াচ্ছেন কেন.....পিঠের বাইপাস ম্যাসাজটা আমি দেবই' ।

বাইপাস ম্যাসাজ !! আতঙ্কে আমার পেটের ভেতর সবকিছু যেন ফণীর ঝড়ের মতো গুলিয়ে উঠল। আমি প্রায় কেঁদে উঠে বললুম, 'ওরে ! আমার কোমরের দায়ভার তোর না নিলেও চলবে ভাই, বাঁকা পথ দিয়ে তাও মানুষ ভবনদী পেরোতে পারে কিন্তু ভাঙা কোমর নিয়ে আমি যে সরু নালাও টপকাতে পারব না'।

আমার কথার মর্মার্থ তার মাথায় ঢুকল কিনা জানি না কিন্তু আমাকে সে একেবারে প্রশ্রয় দিল না। বলল, 'অত ভয় পাচ্ছেন কেন দাদা, দেখুন না কেমন জম্পেশ টাইপের করে দিচ্ছি' ।

আড়চোখে দেখলাম, আশেপাশের লোকজন কেউই এই যাত্রাপালাটা মিস করছে না। দু চারজন সেলুনের বাইরেও জড়ো হয়েছে বিনি পয়সার কমেডি দেখবে বলে। আমার কেবলই মনে হতে লাগল আমার মতো অসহায় জীব এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আর কেউ নেই।

তবে উল্টোদিক থেকে ভয় পাওয়ার কথা বললে চিরকালই বাঙালির পৌরুষে আঘাত লাগে, আমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। ভিতরে ভিতরে কলজের মুড়োটা আচ্ছা করে বেঁধে নিলাম আমার দুঃসাহসের ফিতে দিয়ে। সাদা আলখাল্লার ভেতর দিয়ে প্রাণপণে চেয়ারের হ্যান্ডেল চেপে ধরলাম। এরপর যা শুরু হল তার সাথে একপ্রকার নটরাজের নৃত্যেরই তুলনা করা যায়।

কোনোমতে নাক মুখ গুঁজে নিরুপায় হয়ে সহ্য করতে লাগলাম সেসব। ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়ালের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করল না। প্রীতি জিনটা নির্ঘাত শাহরুখ আর আমিরের সাথে মিলে আমায় ট্রোল করছে। মনে হল সেলুনের বাকিরাও ভোগের বাতাসের মতো সবটুকু সাঁতলে লুটেপুটে নিচ্ছে। আমি প্রায় মাটিতে মিশে যেতে লাগলাম। সীতা হলে বলতুম - ধরণী দ্বিধা হও। কিন্তু এখানে কোনো কিছুই বলে উঠতে পারলুম না। আর বললেই বা ! শুনছে কৈ ?

পিঠ চাপড়ানো শেষ হতে রাজু এবার কোমর নিয়ে পড়ল। যা চলল তাতে করে কোমরের কৌমার্য হরণ হল বলা যায়। চোখের সামনে আমার বাঁচার কোনো রাস্তাই আর খোলা দেখতে পেলুম না। কোমরের ওপর দু আঙ্গুল দিয়ে চেপে চেপে সে আমার শিরদাঁড়ার প্রতিটা হাড় যথাস্থানে আছে কিনা একেবারে অর্থোপেডিক ডাক্তারের মতো পরখ করতে লাগল। আয়নায় নিজের কাতর মুখটা দেখে আমি আরও বিমর্ষ হয়ে পড়লুম। নিজের এতো করুন মুখ আমি আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। আমার অন্তঃরাত্মা হাহাকার করে উঠল সে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ম্যাসাজের ঠেলায়।

আরো মিনিট দশেক বাদে সে বিষাক্ত তান্ডব শেষ হল। ঝড়ের শেষে তালগাছ যেমন একদিকে হেলে নুয়ে পড়ে, আমিও কতকটা ডানদিকে হেলে কাত হয়ে গেলাম। চেয়ারের হ্যান্ডেলের ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে তৃভঙ্গমুরারীর কায়দায় উঠে দাঁড়ালাম। রাজু একগাল হাসি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। বুঝতে পারলাম দারুন বা সাবাশ টাইপের কিছু একটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মনে হল ওর চুলের মুঠিটা ধরে সামনের আয়নায় মাথাটা ঠুকে চুরমার করে দিই। পুলিশি হ্যাপা আমার পোষাবে না ভেবে ওই প্ল্যান ভেস্তে দিলুম মনে মনেই। বিশেষ কিছুই আর বলতে ইচ্ছে করল না আমার, তবু কোনোরকমে দাঁত চেপে, বাঁকা মুখ করে বললাম, 'টাকাটা রাখ, পুজো ভালো কাটাস.......'

বলেই আর একমুহূর্ত দাঁড়ালাম না সেখানে। বহুযুগ আগে দূরদর্শনে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় মহাভারত সিরিয়ালে শকুনির চরিত্রে গুফি পেন্টাল যেভাবে হেঁটেছিল আমিও কার্যত কতকটা তেমনই আধা খুঁড়িয়ে আধা বেঁকে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা চালালুম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম ম্যাসাজের মায়াজালে আর নয় রে ভাই। যতই হোক, পিতৃদত্ত প্রাণের সাথে ছেলেখেলা করা মোটেই উচিত হয়নি আমার।

যাঁরা নিয়মিত ম্যাসাজ নেন এবং ম্যাসাজ নেওয়াটাকে প্রায় কুটির শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছেন তাঁরা নিশ্চই ভাবছেন, ওঃ ! ছেলের যেন ননীর শরীর, সামান্য ম্যাসাজেই কাতর হয়ে পড়েছে ! কৈ ! আমরা তো এতো বছর ধরে নিচ্ছি আমাদের তো কিছু হয়নি। তাঁদেরকে হাত জোড় করে বলি, আপনারা প্রণম্য ব্যক্তি, ঈশ্বর আপনাদের সাহস ও শক্তি দুটোই দিয়েছেন। তবে বিশ্বাস করুন, এর থেকে মেট্রো বা বনগাঁ লোকালের ভিড় সামলানো সহজ, সারারাত কালী পুজোর মাইকের অত্যাচার এর কাছে নস্যি, এমনকি খালি পায়ে গরম পিচের রাস্তায় হাঁটাও সুখের, কিন্তু যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে তাতে করে ম্যাসাজ কথাটা আমার কাছে যে আমৃত্যু বিভীষিকাময় অসুর হয়েই থাকবে এ বলাই বাহুল্য......

তবে আপনাদের সবার পুজো নির্ভাবনায় ও নির্বিবাদে ভালো কাটুক এই কামনা করি......শুভ শারদীয়া।



#pujobarshiki #bengalishortstories #pujastories #bengalihumours #molat #DebdattaSinha

Saturday, August 10, 2019

বন্ধু চল # ৪ - ফলতা

কতটা মরিয়া হলে মানুষ এমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে সেদিন আমাদের দেখলে খানিকটা হলেও
ছবি : সৌম্য 
বোঝা যেত বোধহয়। বাইক নিয়ে শেষ বেরিয়েছিলাম সেই গত বছর। তারপর যাচ্ছি যাব করে দুটো গ্রীষ্ম, দুটো বর্ষা আর একটা শীত পেরিয়ে গেলেও কিছুতেই ব্যাগ গুছিয়ে উঠতে পারিনি দুজনে। বাইরে না বেরোতে পারার গুমোট ভাবটা ততদিনে কয়লার ধোঁয়ার মতো লতিয়ে উঠেছে। অবশেষে, 'নিকুচি করেছে ! যা থাকে কপালে' বলে দুম করে বানিয়ে ফেললাম একেবারে দুদিন-এক রাত কাটানোর মতো একটা চরমতম প্ল্যান। নাহ, ফ্যামিলি নিয়ে নয়, বরং লাগামছাড়া বাউলের মতো স্বাধীনভাবে কাটানো কয়েক মুহূর্তের অবকাশ যাপন।  

যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাড়িতে সমস্তটা গুছিয়ে বলার আগেই গুগল ঘেঁটে ফলতার হোটেল সি-বার্ড ইন্টারন্যাশনাল বুক করা হয়ে গেল। এ যেন কতকটা সেই স্কুলের পিকনিকে যাওয়ার মতো। বাস তো বুক করা হয়ে গিয়েছে, এখন তো আর না বলার উপায় নেই।

"কি আশ্চর্য ! বুক করে ফেললে ! কোথায় হোটেল ? কি ব্যাপার ? সঙ্গে আমরা গেলেও তো হত ! দিনের দিনে কি ফেরা যেত না" ? এমন ধারার নানাবিধ প্রশ্নকে মেসির মতো ডজ করে কাটিয়ে বেরিয়ে গেলুম দুজনেই। কারণ আগেই বলেছি মরিয়া হলে মানুষ যা ইচ্ছে করতে পারে। অতএব সক্কাল সক্কাল বাইকে তেল ভরে নিয়েই ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে দে চম্পট।

ছবি : নিজস্ব 
মাঝে শুধু একবার মাত্র দাঁড়িয়েছিলাম। আমতলা পেরিয়ে সরিষাহাট মোড় থেকে ডানদিক ঘুরে দু তিন কিলোমিটারের মাথায় একটা স্বামীনারায়ণের মন্দির পড়ে। সে এক দেখার মতো স্থাপত্য। পোড়ামাটির রঙে সে আশ্চর্য শিল্প অজান্তেই মনের মধ্যে সম্ভ্রম জাগায়। মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আবার দৌড়।

অর্জুন, শাল, টিক, মেহগনি আর সেগুন গাছের ছায়ায় ততক্ষনে আমাদের শহুরে ক্লান্তি খসে পড়েছে শরীর থেকে। রাস্তার দু দিকে ঘাড় ঘোরালে অজস্র সবুজের কোলাজে চোখে নেমে আসছে পরম শান্তি। দূর আকাশে ধূসর মেঘের ছবি আঁকা হয়ে চলেছে রাস্তার ওপরেই, বাইকের চাকা সে ছবি ছুঁয়ে ছুটে চলেছে অদম্য, অজানা আকর্ষণে।

প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর নৈনান মোড় থেকে বাঁদিক ঘুরে সটান উপস্থিত হলাম হোটেলের সামনে। আশেপাশে আরও দু একটা হোটেল আছে বটে তবে আমাদেরটা গঙ্গার একেবারে লাগোয়া। এমনিতে জনবসতি শূন্য এলাকা তবে দু একটা ইন্ডাস্ট্রি থাকার ফলে রাস্তার ওপর কখনো কখনো মানুষের দেখা মেলে। অবশ্য আমাদের তাতে কিছু আসে যায়নি। বেলেল্লাপনা করাটাই যাদের লক্ষ্য তাদের কাছে চড়াই পাখিও যা, চিংড়ি মাছও তা।

প্রথমটায় কটেজ বুক করা ছিল। দেখার পর নাপসন্দ করে আমরা সোজা একটা ডিলাক্স রুম ভাড়া
ছবি : হোটেল সি বার্ড 
নিই, ডাবল বেডরুমের ভাড়াতেই। ম্যানেজার কি কারণে সদয় হয়েছিল জানা নেই। বোধহয় ভেবেছিল, আহারে ! অত দূর থেকে দুটো বাঁধা গরু ছাড়া পেয়ে এসেছে, ওদের খানিক শান্তি  না দিলে নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হতে পারে। সে যাইহোক, চটপট লাগেজপত্র রেখে তোয়ালে নিয়ে চলে গেলুম সুইমিংপুলের ধারে। কোমর সমান জল, তাতেই কৈ মাছের মতো এমাথা ওমাথা সাঁতার কেটে নিল সৌম্য। আমার বরাবরই ডুবে যাবার ভয়, তাই আধা ডুবন্ত - আধা ভেসে থাকা অবস্থায় সুইমিং পুলের পার ধরে হেঁটে চলে বেড়ানোটাই নিরাপদ বলে মনে হল । যেদিকটায় জল বেশি, অর্থাৎ আমার গলা পর্যন্ত  ডুবছে সেদিকটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলাম।  সৌম্য যদিও আমাকে সাঁতার শেখাবে বলে জানপ্রাণ লাগিয়ে দিয়েছিল, তবু কাতলা মাছের মতো ঝটাপটি করা ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছুই হয়ে উঠল না সে যাত্রা।

ঘন্টাখানেক পর সুইমিংপুলের মায়া ত্যাগ করে ঘরে এসে চেঞ্জ করে ডাইনিং হলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মিনিট পাঁচেক বাদেই চলে এল গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, এক চামচ ঘি, সোনামুগের ডাল, ঝুরঝুরে আলুভাজা, পাঁচমিশালী তরকারি, চাটনি আর পাঁপড়। খিদের চোটে সেসব কর্পূরের মতো উবে গেল দেখতে দেখতে। আয়েশের ঢেকুর তুলে মৌরি চিবোতে চিবোতে ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘড়ির কাঁটা তখন তিনটে ছোঁব কি ছোঁব না করছে।

ছবি : হোটেল সি বার্ড 
রিমোট নিয়ে এদিক ওদিক চেক করতে করতে দেখলাম কোনো একটা মুভ্যি চ্যানেলে 'লাডলা'  চলছে, সবে শুরু হয়েছে। নব্বই দশকের অনিল কাপুর - শ্রীদেবীর দুরন্ত হিট ছবি। প্রত্যেকটা গান আমাদের মুখস্ত ছিল। মনে পড়ল স্কুলে এক সময় টেবিল বাজিয়ে এই ছবির কত গান করেছি। বিনা বাক্যব্যয়ে ছবিটা দেখতে শুরু করে দিলাম দুজনেই। যেন এতো দূরে এসেছি দুপুরবেলা লাঞ্চ করে 'লাডলা' দেখব বলে। এক একটা সিন্ চলছে আর আমরা নিজেরাই ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছি। আবার ভেবে অবাকও হচ্ছি যে সিন্ পর্যন্ত মুখস্ত আছে আমাদের, এখনও......

দুপুর গড়িয়ে, বিকেল পেরিয়ে কখন সন্ধ্যে নেমেছে আমাদের খেয়াল ছিল না। সিনেমা শেষ হতে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখলাম বাইরেটা ধূসর হয়ে এসেছে। হোটেলের বাইরে গঙ্গার পারে বসে চা খাব বলে ঠিক করলাম। দু মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে গঙ্গার পারে এসে দেখলাম একটা ঢাউস স্টিমার নদীর একেবারে মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে জিরোচ্ছে বলে মনে হল। হলদিয়ার বন্দরটা সীমান্তের শেষে আবছায়া দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপরে টিমটিমে আলোয় একটা চায়ের দোকানে দুধ জ্বাল দিচ্ছে। তার সোঁদা গন্ধ কুণ্ডলী পাকিয়ে নদী পেরিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। দোকানের পাশেই ভূত বাংলোর মতো একটা সাদা দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। অন্ধকারে কয়েক বছরের জীর্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দিকে তাকিয়ে। বেশ একটা গা ছমছমে মায়াবী পরিবেশ। বেশি দূর এগোলাম না আর আমরা। একটা শান বাঁধানো ধাপিতে বসে খানিক গুলতানি করে আবার পায়ে পায়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

ফিরে এসে আবার আরেক রাউন্ড সিনেমা। যেন সিনেমা দেখাই মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের। অবশ্য বিনা বাধায় বাড়িতে বসে সিনেমা দেখতে পাওয়া অনেকটা লটারি পাওয়ার মতোই। যাঁরা বিবাহিত তাঁরা নিশ্চই সহমত হবেন আমার সঙ্গে। আপনার পছন্দের সেরা ছবিটা টিভিতে চলছে, আর আপনি নিশ্চিন্তে বসে মৌজ করে সেটা গিলছেন, এমনটা আপনার কপালে যদি জুটে থাকে তাহলে আপনি যথেষ্ট ঈর্ষার পাত্র। খানিক সিনেমা দেখে আর বেশ খানিকটা আড্ডা মেরে আমাদের সময় কাটছিল। রাতে তন্দুরি রুটি আর মালাই কোফতা খেয়ে দিব্যি আমেজ এল। বকবক করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেদেরই খেয়াল ছিল না।

পরদিন দেরি করে ঘুম ভাঙল। সৌম্যর ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বেচারা কোনো কাজ না পেয়ে ঘরের টেবিল চেয়ার সরিয়ে ঠিক করে রাখছিল। সংসারী ছেলে। সেসবের আওয়াজেই ঘুম ভাঙে আমার। এমন নির্ঝঞ্ঝাট অলস সকাল শেষ কবে পেয়েছিলুম মনে করে উঠতে পারলাম না। সাড়ে দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম কলকাতার দিকে। সঙ্গে করে নিয়ে এলাম বুকভরা অজস্র মুহূর্ত আর বেঁচে থাকার রসদটুকু। তবে বলতে দ্বিধা নেই যে পিছুটান ভুলে এমন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে অনেকটা দূরে রাত কাটিয়ে বাড়ি ফেরাটা একটু বেপরোয়া হলেও দিব্যি লেগেছিল কিন্তু আমাদের।

এই প্রসঙ্গে বলি - পরের বারটার জন্য একটা বেড়ে লোকেশন খুঁজছি.....জানা থাকলে বলবেন তো.....

কৃতজ্ঞতা : সৌম্য ও সৌম্যর বাইক 


ছবি : নিজস্ব 
#bengalitravelblog #traveldiaries #Molat #debdattasinha #bengaliarticle #bengalweekendtour #travelstories

Friday, June 14, 2019

পিচ-বৃষ্টি ও আন্দোলন

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ বৈচিত্রে ভরপুর। সমর্থকদের জন্য এমন অভূতপূর্ব সারপ্রাইজ মাথাকুটেও ভাবা যায় না। মারকাটারি খেলার সাথে সাথে বাম্পার বোনাঞ্জার মতো বৃষ্টি দেখার আনন্দটুকুও যে ষোলো কলায় পূর্ণ  হবে এ বোধহয় অতি বড় সমর্থকও বুঝতে পারেননি। আর এই খেলাকে খেলা না বলে ছেলেখেলা বলব না পুতুল খেলা বলব সেসব ভাবতে গেলে আবার একটা ম্যাচ বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে বরং বসে বসে সুপার সপারের কেরামতি দেখি ও গোটা মাঠ না ঢাকার ফলে মাঠকর্মীদের দ্বিগুন পরিশ্রমের পর্যালোচনা করে দুখী মনটাকে চায়ের কাপে ভিজিয়ে নিই।  

জনৈক উচ্চপদস্থ এক আইসিসি কর্মকর্তা বলেছেন যে ওনারা জানতেন ইংল্যাণ্ডে বৃষ্টি হবে তবে দ্বিগুন বৃষ্টি হবে সেটা নাকি আগাম আঁচ করতে পারেন নি। আবহাওয়াবিদরা অনেক আগেই বলেছেন এই সময়টায় বৃষ্টি হবে - এটাই যথেষ্ট নয় কি এবং সেটা জানার পরও এই সময় ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফেললেন কি কারণে ? থর কি হাতুড়ি মারফত স্বপ্নাদেশে বরাভয় দান করেছিলেন নাকি আগাম সতর্কবার্তাকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে কর্মকর্তারা বলতে চেয়েছিলেন "চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা"...…..

১৮টা ম্যাচের মধ্যে এখনো অবধি ৪টে ম্যাচ বাতিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে এই বছরটা বাদ দিলে এখনো অবধি শুধুমাত্র দুটো ম্যাচই বাতিলের খাতায় নাম তুলেছে। একটি ২০১৫ সালে এবং আরেকটি ১৯৭৯ সালে। এক্ষেত্রে রিসার্ভড-ডের উপকারিতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আইসিসির কর্মকর্তারা বলছেন যে প্রত্যেকটা ম্যাচের জন্য রিসার্ভড-ডে রাখা হলে বহুদিন ধরে খেলা চালিয়ে যাওয়া পারতপক্ষে সম্ভব ছিল না। হরিবোল ! খেলাটা যখন বিশ্বকাপ এবং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের নজর থাকবে যেখানে সেটা নিয়ে আরও একটু দূরদর্শিতা দেখালে কি বিগ বাজারের উইকেন্ড ডিসকাউন্টটা মিস হয়ে যেত ! একটি চমকপ্রদ তথ্য দিই। ১৯৯৯ সালে এই ইংল্যান্ডেই আয়োজিত বিশ্বকাপে প্রত্যেকটি ম্যাচের জন্য একটি করে রিসার্ভড-ডে রাখা ছিল। 

আগামী দিনগুলোর মধ্যে যে সব দিনে ম্যাচ হবে সেখানে কয়েকটা দিন বাদ দিলে বাকি প্রায় সবকটা ম্যাচেই বৃষ্টি হবার প্রভূত সম্ভাবনা আছে - এমনটাই নাকি পূর্বাভাস। হরি হে মাধব ! চান করব না গা ধোব ! সুতরাং যে সমস্ত টিমের ম্যাচ বাতিল হতে থাকবে সেমি ফাইনালে ওঠাটা তাদের পক্ষে ততটাই দুঃসাধ্য হতে থাকবে। সবথেকে আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে ইংল্যান্ডের প্রায় সবকটা মাঠেই নাকি জল নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। শুধু পিচ ও পিচের চারিধারটা ঢেকে ফেললেই নিশ্চিন্তি, এতেই রাত্তিরে ভালো ঘুম হবে। ওরে পাগল ! ইডেনটা একবার দেখে যেতে পারতিস তো। তাছাড়া চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে সাব-এয়ার ড্রেনেজ সিস্টেমটা শিখে নিলেও তো হত। শ্রীলঙ্কায় পর্যন্ত গোটা মাঠ ঢাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আদ্যিকালের ভেঁপু বাজিয়ে কি আর জাস্টিন বিবারের শো হয় গুরুদেব ! 
   
এমতাবস্থাতেও আইসিসির পক্ষ থেকে তেমন কোনো হেলদোল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। পরের ম্যাচগুলো ভেস্তে গেলে ঠিক কি হতে পারে তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। ভাবটা এমন যে ছাড়ুন তো মশাই, মোটে তো চারটে বছর, ও দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। পরের বার নাহয় ভরা জ্যৈষ্ঠে  সাহারা মরুভূমিতে স্টেডিয়াম করে বিশ্বকাপ করাব। বৃষ্টি হলেও বালিতে শুষে নেবে। সে আপনারা করুন গে, কিন্তু তাই বলে সমর্থকদের অপেক্ষা, আনন্দ আর উত্তেজনা মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে, তার কি হবে ? কয়েকশো কোটি টাকার ভোজে প্যান্ডেলটাই ঠিক মতো বেঁধে উঠতে পারলেন না যে। অগত্যা সন্ধ্যের দিকে টিভি খুলে চপ মুড়ি খেতে খেতে শাপ শাপান্ত করা ছাড়া আর তেমন কোনো গতি নেই সমর্থকদের। একটা লাভ অবশ্য আছে। চপ মুড়ির শিল্পে একটা উন্নতি দেখা দিলেও দিতে পারে।
 



#molat #rainatengland #matchabandoned #CWC2019 #DebdattaSinha
   
 

Thursday, May 2, 2019

অনুপদ্য - ২২

জানলা ঘেরা আতস কাঁচে
                 সূর্য ধরার ছাপ
বৈশাখী রোদ প্রহর গোনে
           চৌকো ঘরের মাপ

বাইরে আলো রঙের প্রলেপ
                মুক্ত মনের দ্বার
ঘরের ভিতর জমাট কালো
                ভীষণ অন্ধকার


ছবি : নিজস্ব 














#shortbengalipoem #bengaliblog #shortpoems #banglakobita #Molat #DebdattaSinha